শনিবার, জুন ২২, ২০২৪

ডিবি পরিচয়ে তুলে নেয়ার পর ৯ বছর ধরে নিখোঁজ ছাত্রলীগ নেতা বকুল

যা যা মিস করেছেন

মো. বকুল খান। পড়াশোনা করতেন রাজধানীর তেজগাঁও সরকারি কলেজে। পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করতেন হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার বহরা ইউপি ছাত্রলীগ সভাপতির। জনপ্রিয় ছিলেন এলাকায়। ইউপি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনও করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি ভোররাতে রাজধানীর সদরঘাট থেকে ডিবি পরিচয়ে সাদা পোশাকের কয়েকজন লোক তাকে তুলে নিয়ে যায়। তাও দায়িত্বরত পোশাকধারী পুলিশ সদস্যদের সামনে থেকে। এরপর আর সন্ধান মেলেনি তার।

দীর্ঘ ৯ বছর ধরে নিখোঁজ ২৫ বছরের টগবগে এই তরুণ। বকুল নিখোঁজের পর দায়ের হয়েছে জিডি ও মামলা। সন্তানকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন মা। প্রতিবাদ সমাবেশে দাঁড়িয়েছিলেন রাস্তায়ও। বকুলের সন্ধানের জন্য তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, র‌্যাব ডিজিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছেও ধরনা দিয়েছেন দিনের পর দিন। কারও কাছ থেকে পাননি আশার বাণী। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের একজন নেতা এভাবে নিখোঁজ হয়ে যাবেন তা ঘুণাক্ষরেও বিশ্বাস করতে পারেনি পরিবার। পুত্র শোকে স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে পড়েন গর্ভধারিণী মা। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী হয়ে মাস দুয়েক আগে তিনিও চলে যান না ফেরার দেশে।

বকুল নিখোঁজের ঘটনার বিবরণ এভাবেই মানবজমিন-এর কাছে তুলে ধরেন বড় ভাই আজমল খান। তিনি বলেন, ২০১৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি জোহরের পর আবদুল মালেক নামের একজন আমাকে ফোন করেন। তিনি আমাকে বলেন, বকুলসহ আমরা তাবলীগ জামাতের চারজন সাথী (আখাউড়ার সিঙ্গারবিলের আবদুল মালেক, ভোলার মনির, জামালপুরের আলম) বরিশাল থেকে চিল্লা শেষে লঞ্চে করে ঢাকায় ফিরি। ভোরে পৌঁছাই সদরঘাটে। এরপর লঞ্চে ব্যাগ রেখে টার্মিনালের সামনে যাই।

আমরা ৪ জন গাড়ি খুঁজছিলাম কাকরাইল মসজিদে যাওয়ার জন্য। এ সময় আমাদের সামনে কালো গ্লাসের একটি হাইয়েস এসে থামে। গাড়ি থেকে ৫-৬ জন সাদা পোশাকের লোক নেমে আসেন। সবার কাছেই ছিল ভারী অস্ত্র। তারা ডিবি পুলিশের পরিচয় দেন। ঘটনাস্থলের পাশেই দায়িত্ব পালন করছিলেন পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা। ডিবি পুলিশের পরিচয় পেয়ে তারা সামনে ভিড়েননি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বকুলকে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে তুলে ফেলে। এরপর দ্রুত গাড়িটি ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।

আজমল খান বলেন, বকুল গ্রেপ্তারের খবর শুনেই দ্রুত ঢাকা ছুটে যাই। প্রথমে কোতোয়ালি থানায় খোঁজ নেই। থানা থেকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি অস্বীকার করে। এরপর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে যাই। সেখানে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা জানান, বকুল নামে কাউকে ডিবি পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি। এরপর তৎকালীন লালবাগ জোনের ডিসি হারুন অর রশিদের কাছে যাই। তিনিও বকুলকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি অস্বীকার করেন। ২০১৩ সালের ৪ঠা মার্চ বকুলের নিখোঁজের বিষয়ে লালবাগ থানায় জিডি করি। তারপরও আমার ভাইকে ফিরে পাওয়ার কোনো আলামত পাইনি।

বাধ্য হয়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সানাউল হকের দ্বারস্থ হই। তিনি তৎকালীন র‌্যাবের ডিজি মোখলেসুর রহমানকে আমার সামনেই ফোন করেন। বকুলকে আটকের বিষয়ে কোনো তথ্য আছে কিনা জানতে চান। জবাবে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান। বকুলের খোঁজে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার শরণাপন্ন হই। তিনি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে বকুলের সন্ধান চেয়ে ফোনও করেন। কিন্তু কারও কাছ থেকে কোনো সুখবর পাইনি। শেষমেশ ভাইয়ের সন্ধানের জন্য তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের কাছে যাই। মন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে সাক্ষাৎ করে বকুলের ছবিও দিয়ে আসি। কিন্তু বকুলের কোনো হদিস মেলেনি।

তিনি বলেন, যেখানেই অজ্ঞাত লাশ পাওয়ার খবর পেয়েছি সেখানেই ছুটে গেছি। বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গ, জেলখানায় খোঁজ নিয়েছি। কিন্তু কোথাও আমার ভাইয়ের সন্ধান পাইনি।

এরপর ২০১৩ সালের ১৮ই মার্চ হবিগঞ্জ প্রেস ক্লাবে আমার মাকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বকুলের সন্ধান দেয়ার দাবি জানাই। মাধবপুর পৌরসভার সামনে মানববন্ধন করেন হবিগঞ্জ জেলা ও উপজেলা ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ। মানববন্ধনে বকুলকে দ্রুত ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান ছাত্রলীগ নেতারা। তারপরও আমার ভাইয়ের সন্ধান পাইনি।

আজমল খান বলেন, ২০১৩ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর মামলা দায়ের করি কোতোয়ালি থানায়। আমি নিজেই মামলার বাদী হই। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোলাম রসুল সদরঘাটের ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ওই পুলিশ সদস্যরা ডিবি পুলিশ পরিচয়ে একজনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি দেখেছেন বলে স্বীকার করেন। মামলার তদন্তের অগ্রগতি বলতে এতটুকুই। তৎকালীন কোতোয়ালি থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক জানান, আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করেছি। কিন্তু তার কোনো সন্ধান পাইনি।

বকুল গুম হওয়ার কারণ সম্পর্কে আজমল খান বলেন, আমার ভাই গুম হওয়ার কিছুদিন আগে আমাদের গ্রামে একটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ওই ডাকাতরা যাওয়ার সময় বাড়ির বাসিন্দা টিপু নামের এক যুবককে খুন করে। খুন হওয়া টিপুর ভাইয়েরা প্রশাসনের উচ্চপদস্থ পদে চাকরি করেন। ওই ঘটনার পরপর এলাকার কয়েকজন চিহ্নিত ডাকাতকে গ্রেপ্তার করান তারা। গ্রেপ্তারকৃত ডাকাতদের দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করান। ওই জবানবন্দির জেরে ওই মামলায় আসামিদের তালিকায় বকুলের নাম ঢুকিয়ে দেন। অথচ এর আগে বকুলের নামে কোথাও একটি জিডিও ছিল না। এলাকার সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতো বকুল। সবাই তাকে ভালো ছেলে হিসেবে জানতো। এমন কি খুন হওয়া টিপুর সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক ছিল বকুলের।

ওই ঘটনার পরপরই আমার ভাইকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে গ্রেপ্তার করে তুলে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, আমার ভাই এলাকায় বেশ জনপ্রিয় ছিল। ইউপি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে চেয়েছিল। সেই জনপ্রিয়তাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজমল খান বলেন, আমরা দুই ভাইয়ের মধ্যে বকুল ছিল ছোট। পড়াশোনার পাশাপাশি রাজনীতি করতো। মাধবপুরের বহরা ইউনিয়নের নির্বাচিত ছাত্রলীগের সভাপতি ছিল। তবে রাজনীতি করলেও অনেক ধার্মিক ছিল বকুল। নিয়মিত নামাজ পড়তো, রোজা রাখতো। প্রায় সময়ই তাবলীগ জামাতের সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় চিল্লায় যেতো। নিখোঁজের কয়েকদিন আগে তাবলীগ জামাতে বরিশাল গিয়েছিল। পুত্রশোকে আমার মা স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে যান। দীর্ঘ চার বছর শয্যাশায়ী হয়েছিলেন তিনি। গত দুই মাস আগে মারা যান আমার মা।

তিনি অভিযোগ করেন, যে জামাতের সঙ্গে বকুল চিল্লায় গিয়েছিলেন সেই তাবলীগ জামাতের আমীর বকুল নিখোঁজের কিছুদিন পরই দেশের বাইরে চলে যান। সেই আমীর হয়তো বকুলের বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন।
সরকারের কাছে ভাইয়ের জীবিত সন্ধান দাবি করে আজমল খান বলেন, মারা গেলে অন্তত ভাইয়ের কবর জিয়ারতের সুযোগটুকু চাই।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন মাধবপুর প্রতিনিধি ইয়াছিন তন্ময়)।

অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।

প্রিয় পাঠক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্যামেইলবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন themailbdjobs@gmail.com ঠিকানায়।

More articles

সর্বশেষ

x  Powerful Protection for WordPress, from Shield Security
This Site Is Protected By
Shield Security