মৃত্যু অবধারিত ও সুনিশ্চিত বিষয়। তবে, ‘কেউ জানে না আগামীকাল সে কী উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন দেশে সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।’ (সুরা লোকমান: ৩৪)
একজন মুমিনের দরজায় যখন মৃত্যু কড়া নাড়ে, তখন তাকে হুঁশ ঠিক রেখে যে কাজগুলো করতে হয়, তা নিচে বর্ণনা করা হলো—১) ধৈর্যধারণ করে আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা। কারণ হজরত জাবের (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে তাঁর ওফাতের তিনদিন আগে বলতে শুনেছি- ‘তোমাদের প্রত্যেকে যেন আল্লাহর প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।’ (মুসলিম: ২৮৭৭; আবু দাউদ: ৩১১৩; ইবনে মাজাহ: ৪১৬৭; বায়হাকি ও আহমদ: ১৩৭১১ ও ১৩৯৭৭)
২) রোগীর উচিত তার যাবতীয় গুনাহের জন্য আল্লাহর আজাবকে ভয় করা এবং তাঁর রহমত প্রত্যাশা করা। (তিরমিজি: ৯৮৩; ইবনে মাজাহ: ৪২৬১; মেশকাত: ১৬১২-তাহকিক আলবানি; সহিহ তারগিব ওয়াত তারহিব: ৩৩৮৩)
৩) কষ্ট যতই হোক, মৃত্যু কামনা করা যাবে না। কারণ, রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁর চাচা আব্বাস (রা.)-কে মৃত্যু কামনা করতে নিষেধ করেছেন। (আহমদ: ২৫৬৪০; ইবু ইয়ালা: ৭০৭৬; হাকিম: ১/৩৩৯; ইমাম বুখারি, মুসলিম ও বায়হাকিও এধরণের হাদিস বর্ণনা করেছেন)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, যদি মৃত্যু কামনা করতেই হয়, তবে যেন এভাবে বলে যে, হে আল্লাহ! যে পর্যন্ত আমার জন্য আমার জীবন কল্যাণকর হয়, সে পর্যন্ত আমাকে জীবিত রাখো, আর যদি মৃত্যুই আমার জন্য কল্যাণকর হয়, তবে আমাকে মৃত্যুদান করো। (বুখারি: ৫৬৭১,৬৩৫১; মুসলিম: ২৬৮০; তিরমিজি: ৯৭০, ৯৭১; নাসায়ি: ১৮২০,১৮২১, ইবনে মাজাহ: ৪২৬৫; আহমদ: ১২২৯৪)
৪) ঋণ, আমানত বা জোরপূর্বক দখলকৃত কিছু থাকলে তা পরিশোধ করে দেওয়া। তার পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব না হলে, অভিভাবক কিংবা উত্তরসূরীদের সেগুলো পরিশোধের অসিয়ত করে যাওয়া। কারণ, কেয়ামতের মাঠে পাওনাদারকে সওয়াব দেওয়ার না থাকলে, পাওনাদারের গুনাহগুলো নিয়ে জাহান্নামে যেতে হবে। (বুখারি: ২৪৪৯, আহমদ: ৯৩৩২, ১০১৯৫; বায়হাকি: ৩/৩৬৯; মেশকাত: ৫১২৬-তাহকিক আলবানি)
৫) জীবনে কাউকে গালি দিয়ে থাকলে, কারো বিরুদ্ধে অপবাদ দিয়ে থাকলে, অন্যায়ভাবে প্রহার, রক্তপাত করে থাকলে তাদের কাছ থেকে ক্ষমা নেওয়া জরুরি। তা না হলে অত্যাচারিতদের গুনাহগুলো তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে, অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। হাদিসে ওই ব্যক্তিকে মুফলেস বা নিস্ব বলা হয়েছে। (মুসলিম: ২৫৮১, তিরমিজি: ২৪১৮,২৪১৯; আহমদ: ৭৯৬৯, ৮২০৯)
৬) আত্মীয়দের মধ্য থেকে যারা তার সম্পদের ভাগীদার হবে না, শুধুমাত্র তাদের জন্যই কিছু সম্পদ দান করার উদ্দেশ্যে অসিয়ত করা উচিত বা ওয়াজিব। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে ঈমানদারগণ!) তোমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে যে, যখন তোমাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হবে, যদি সে কোনো সম্পদ রেখে যায়, তবে পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের জন্য ন্যায়ভিত্তিক অসিয়ত করবে। এটি মুত্তাকীদের দায়িত্ব। (সুরা বাকারা: ১৮০)
৭) তবে, এক্ষেত্রে সে তার সম্পদের সর্বোচ্চ এক তৃতীয়াংশ অসিয়ত করতে পারবে। এর বেশি পারবে না। বরং কম করাই উত্তম। কারণ রাসুল (স.) এক তৃতীয়াংশকেই বেশি আখ্যা দিয়েছেন। (বুখারি: ১২৯৬; মুসলিম: ১৬২৮; তিরমিজি: ২১১৬; নাসায়ি: ৩৬২৬)
৮) ছেলে-মেয়ে, স্বামী বা স্ত্রী, পিতা-মাতাসহ আরো যারা মৃত ব্যক্তির সম্পদের ভাগীদার হবে, তাদের নামে অসিয়ত করা যাবে না। কারণ, রাসুল (স.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন—‘আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক হকদারের হক দিয়ে দিয়েছেন (অর্থাৎ নির্ধারিত পাওনা সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছেন) অতএব, কোনো ভাগীদারের জন্য অসিয়ত নেই’। (আহমদ: ২১৭৯১; বায়হাকি: ৬/২৬৪, আবু দাউদ: ২৮৭০, ৩৫৬৫; তিরমিজি: ২১২০; ইবনে মাজাহ: ২৭১৩)
৯) সীমালঙ্ঘন করে অসিয়ত করা নাজায়েজ। যেমন সম্পূর্ণ সম্পদ অসিয়ত করে দেওয়া। যদি এরকম ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে অসিয়ত বাস্তবায়িত হবে এক তৃতীয়াংশের ক্ষেত্রে। বাকী সম্পদ ওয়ারিশরা প্রাপ্য অনুযায়ী বণ্টন করে নেবে। ( আহমদ: ১৯৩২৫, ১৯৩৪৪, ১৯৪৯৯; সহিহ মুসলিম: ১৬৬৮; তিরমিজি: ১৩৬৪; নাসায়ি: ১৯৫৮; আবু দাউদ: ৩৯৫৮; ইবনে মাজাহ: ২৩৪৫)
১০) জানাজা সম্পাদনে বেদআত যেন না হয়, সেজন্য এই অসিয়ত করে যাওয়া উচিত যে, আমার মৃত্যুর পরে যাবতীয় কাজ যেন সহিহ সুন্নাহ মোতাবেক করা হয়। কারণ, রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সাহাবিগণও এই মর্মে অসিয়ত করতেন। যেমন হুজাইফা (রা.) করেছিলেন। (সহিহ তিরমিজি: ৯৮৬; ইবনে মাজাহ: ১৪৭৬; মুসনাদে আহমদ: ২২৯৪৫)
১১) অঙ্গিকার পূরণ করা। কারণ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আর অঙ্গীকার পূর্ণ করো। অবশ্যই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল: ৩৪)
তবে, সম্ভব না হলে, সেটি ওয়ারিশরা পূর্ণ করবে। মানত, কাফফারা আদায় করাও সন্তান বা ওয়ারিশের কর্তব্য। এমনকি মৃতব্যক্তির শুরু করা খারাপ কোনো কাজ চলমান থাকলে, সেগুলোও বন্ধ করা সন্তানের করণীয়।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মৃত্যুপূর্ববর্তী গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো যথাযথ আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।