বিশেষ প্রতিনিধি : নেত্রকোনার অহংকার কিংবদন্তি বাউল সাধক ও বরেণ্য গীতিকবি আব্দুল মজিদ তালুকদারের আজ (মঙ্গলবার) ৩৩তম প্রয়াণ দিবস আজ। তিনি ১৯৮৮ সালে ২৯ শে জুন নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পারিবারিক কবরস্থানেই দেশ বরেণ্য সাধকে সমাহিত করা হয়।
প্রয়াত কিংবদন্তি গীতিকবি মরমী বাউল সাধক আব্দুল মজিদ তালুকদার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে পারিবারিকভাবে মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। তাছাড়া রামপুর বাজারস্থ আব্দুল মজিদ তালুকদার শিল্পী গোষ্ঠীর কার্যালয়ে সীমিত পরিসরে সঙ্গীত পরিবেশনার আয়োজনেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বরেণ্য গীতিকবি জীবদ্দশায় বহু কালজয়ী গান রচনা ও সুর করে গেছেন। যা আজো লোকমুখে ফেরে। এবং বিভিন্ন ইইলেকট্রিক গণমাধ্যমেও প্রচার হয়। কবি শেষ ইচ্ছা মহান প্রভূ যেন কবুল করেছিলেন। যা সত্যি হলো কালজয়ী এই গান–“আমায় এসে নিও নাইওর আষাঢ় মাইসা দিনে” ৮৮ সালে ২৯ জুন এই ভরা আষাঢ়েই পরপারে নায়র যান কবি।
আব্দুল মজিদ তালুকদার নেত্রকোনার সমাজ সংস্কৃতি অঙ্গনে অবিস্মরনীয় ধ্রুপদী নাম। চল্লিশের দশকে আব্দুল মজিদ তালুকদার গানের ভেতর দিয়ে যে মরমী ভুবন নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে তাঁর গানে রাজনীতিবিদ, পণ্ডিতগণ সহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে বিস্মিত-মুগ্ধ-অভিভূত হয়েছিল। এই গীতিকবির গানই ছিল তাঁর প্রাণ।
তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও, পাকিস্তান বেতার, বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও গ্রামোফোন রেকর্ড সহ নানা মাধ্যমের একজন প্রথম সারির গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। তার লেখা প্রায় সাড়ে ছয়শত গানের সংকলন ও তার জীবন তত্ত্ব নিয়ে বরেণ্য গবেষক অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা স্যারের সম্পাদনায় প্রকাশিত সংকলন মজিদ গীতি সমগ্র বইয়ের ভূমিকায় মজিদ গীতির সংগ্রহকার ও সম্পাদক অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা উল্লেখ করেন,নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ অঞ্চলের সমস্ত কথাই যেন আব্দুল মজিদ তালুকদার তাঁর গানে বলে গেছেন ।
এমনকি পল্লীবাসী জীবন নিয়ে বলার মতো অবশিষ্ট আর কিছুই যেন বাকি রাখেননি মরমী কবি আবদুল মজিদ তালুকদার । তিনি তার জীবনভর এই সমাজ-সংহতি, নর-নারীর জীবনের পলে পলে যা দেখেছেন, যা অনুভব করেছেন তাকেই বাণী দান করেছেন, তার মনের ভাষায়, তারই গানে । ফলে আব্দুল মজিদ তালুকদার এর মত লোককবির দ্বারাও পরিণতি লাভ করেছে নেত্রকোনা জেলার লোকসংগীত ।
আব্দুল মজিদ তালুকদার বিশ শতকের শুরু থেকে নেত্রকোনা এলাকার সাম্যবাদের গান, গোষ্ঠীবদ্ধ গ্রামীণ সমাজের গান তুলে ধরেছেন লোক মানুষের জন্য । এই বাংলার সৌন্দর্য তার গানে কাব্যের সুরে চিত্রে পুষ্ট হয়েছে । বাউল সুষমা ধ্যানে নিজের জীবনের মধ্যে গ্রহণ করে জীবনটাই কাটিয়েছেন বাউলিয়ানায় । মজিদ তালুকদার এর জীবনে ঐতিহাসিক অর্জন ছিল প্রচুর । ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে নেত্রকোনার নাগড়ার মাঠে অবিভক্ত ভারতবর্ষের ‘সর্বভারতীয় কৃষক সম্মেলন’ এ গান পরিবেশন করেন । বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরুর দিকে ‘রাষ্ট্র ভাষা চাই’ গান লিখা ও পরিবেশন করা, ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ‘কাগমারির সম্মেলন’ এ অংশগ্রহণ করা এবং ছয়দফা, এগারদফা ও মুক্তিযুদ্ধ এর মতো ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে গান পরিবেশন করে জন সচেতনতা সৃষ্টি করে ভূয়সী প্রসংশিত প্রশংসিত হয়েছিলেন। তার ঘটনাবহুল জীবন ও কর্মের কথা “মজিদ গীতি সমগ্র” গ্রন্থের প্রথম অংশে বর্ণিত হয়েছে ।
বাউল সাধক মরমী কবি আব্দুল মজিদ তালুকদার ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে (বাংলা ১৩০৫সাল) ৫ জানুয়ারি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার দলপা ইউনিয়নের ইটাচকি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবা নাম ছিল হাজী আমছর তালুকদার ও মায়ের নাম মৌলানা মগলের মা । দুই ভাই ও চার বোনে মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড় ।
নেত্রকোনার কিংবদন্তি এই বাউল সাধকের দাম্পত্যজীবনে ৩ পুত্র ও কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। তাদের মধ্যে ছোট ছেলে আবুল বাসার তালুকদার বর্তমান সময়ের একজন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী। বাবার আদর্শ বুকে ধারণ করে নেত্রকোনা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বহু সুনাম কুড়িয়েছেন। তিনি বর্তমানে কন্ঠশিল্পী হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে তালিকাভুক্ত হয়েছেন।