মজিবুর রহমান : “সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো বেলা গেল ঐ, কোথায় গেল হাঁসগুলো থৈ-থৈ-থৈ” এই কবিতায় যা লেখা তিনি আমাদের প্রখ্যাত পল্লী কবি, প্রাবন্ধিক, লোকসাহিত্যের গবেষক ও সংগ্রাহক রওশন ইজদানী। আজ ২০ জুন তাঁর ৫৪ মৃত্যু দিবস। এক সময় বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে ঘটা করে পালন হতো কবির জন্ম-মৃত্যু বর্ষিকী। দিনে দিনে ভাটা পড়েছে এই আয়োজন। এখন মৃত্যুবার্ষিকীতে পরিবারিকভাবে মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করে থাকেন পরিবারের লোকজন। গ্রামে প্রতিষ্ঠিত কবির নামে ‘রওশন ইজদানী একাডেমী’ পক্ষ থেকেও মাঝে মাঝে মৃত্যু দিবসটি পালন করে থাকে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে কবি রওশন ইজদানী সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই অনেকের। নতুন প্রজন্মের কাছে কবিকে তুলে ধরা কিংবা ছড়িয়ে দেয়ার স্থায়ী মাধ্যমও নেই। কবি রওশন ইজদানী ছিলেন সাহিত্য পরিমন্ডলে একজন খ্যতনামা পল্লীকবি।
কবি রওশন ইজদানী ১৯১৭ খ্রীঃ ও বাংলা ১৩২৪ সালের ১৫ ফাল্গুন নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় বিদ্যাবল্লভ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ আলী কবির। পিতা শেখ আলী কবিরের পেশা ছিল কবিরাজি চিকিৎসা। ১০ বছর বয়সে পিতার মৃত্যু হলে স্থানীয় ওল্ড স্কিম মাদরাসায় রওশন ইজদানীর বিদ্যাশিক্ষার হাতে খড়ি। উপজেলার আশুজিয়া হাইস্কুলে ভর্তি হন রওশন ইজদানী। সেখানে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যায়ন করেন তিনি। ১৮ বছর বয়সে মাতৃ বিয়োগের পর তার লেখাপড়ায় ছেদ পড়ে। মাতৃবিয়োগের পর উদাসীন হয়ে বাউলদের প্রতি ঝুঁকে পড়েন ইজদানী এবং বাউল গান গেঁয়ে সময় কাটান। এর কিছুদিন পর জুবায়দা আখতার খাতুনকে বিবাহ করে সংসার ধর্মে প্রত্যাবর্তন করেন।
১৩৪৬ সালে গ্রামের গ্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন ইজদানী। এর কিছুদিন পরে ঋণ সালিসি বোর্ডের কেরানির চাকুরিতে যোগদান করেন। ১৯৪৮ সালে ‘দৈনিক আজাদে’ এর রিডিং সেকশনে যোগদান করেন। এরপর ১৯৫৮ সালে ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশনের প্রুফ রিডার, গ্রেড-১ পদে যোগ দান করেন। ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য ১৯৫৯ সালে প্রুফ রিডারের চাকুরি ছেড়ে তিনি গ্রামের বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করেন ও সাহিত্য সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।
রওশন ইজদানী মূলতঃ পল্লী কবি হিসেবে খ্যাত। তিনি রসূল (সা.) এর উপর একটি পুরো কাব্য খাতামুন নবীঈন রচনা করেন। তিনি লোাকসাহিত্য নিয়ে অনে লেখালেখি করেছিলেন। তার গবেষণা গ্রন্থ “মোমেনশাহীর লোক সাহিত্য ও পূর্ব পাকিস্তানের লোক সাহিত্য”। কবি রওশন ইজদানীর প্রকাশিত গ্রন্থ ২৬টি ও অপ্রকাশিত গ্রন্থ ১৮টি। পাঠ্য পুস্তক প্রকাশনার সংখ্যা ৬টি। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো নীল দরিয়া, মরুর কাফেলা, হৃদয় বীণা, ভাঙ্গা বীণা, বজ্রবাণী, ইউসুফ জুলাখা, মোমেনশাহীর প্রাচীন পল্লী ও সমাজ জীবন ইত্যাদি। চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকের অন্যতম কবি রওশন ইজদানী। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই কবি সাহিত্যের সকল শাখায় করেছেন বিচরণ।
নেত্রকোনার খাঁটি আঞ্চলিক ভাষায় লিখে ‘খাতামুন নাবীঈন’ কাব্যগ্রন্থের জন্যই তিনি ১৯৬০ খ্রীষ্টাব্দে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে ২০ জুন এই মহান কবি ও লোক সাহিত্যিক রওশন ইজদানী মৃত্যুবরণ করেন।