ধমণীতে স্পন্দিত মানুষগুলোর এমন অসময়ে এমনি করে প্রস্থান কিছুতেই সয়ে নেয়া যাচ্ছিল না। অনুভবের কিম্বা চোখে চোখের পরশ কথাগুলো অব্যক্ত- অবলা রয়ে গেল! সে হা-হুতাশের বোঝা বয়ে বেড়াবো আগামী অনির্দিষ্ট সময়গুলো। হায়! আর একটু সময় পেলে আর কিছু মুহূর্ত মুঠোয় থাকলে আপন ভালোবাসার নতজানু প্রকাশ উৎসর্গ করতাম।
শোকে কাতর বা পাথর নয়; কি হবে এখন লিখে! এ তো আত্মতৃপ্তি মনোরঞ্জনের মতো! মানুষগুলো তাদের দুঃখ স্পর্শ করারও সুযোগ দেয়নি! না পেরেছি এক মুঠো মাটিও অর্ঘ দিতে যা অনন্ত পৃথিবী তাকে ধারণে রাখবে। অথচ: আমার যতটুকুই টিমটিমে উজ্বল-অস্তিত্ব সবই তো তাদের আলোকচ্ছটার স্ফুরণ। কৃতজ্ঞতা নিবেদনের আর অবকাশ নেই। কতটুকুইবা প্রকাশ করা যায়; করলেই বা কি! সে তো আর তাকে শোনানো যাবে না।
শাহরিয়ার ভাই! আপনার মুখে মুখ তুলে কথা বলার উদ্যত্ত আমার কখনো হয়নি। কোন প্রশ্ন রাখিনি। কিন্তু আজ বলবো! কেন এমন করলেন? কেন এমন হলো! কেন আর একটিবার ডাক দিলেন না? আমি কি কভূ অবাধ্য হয়েছি? দেখবেন, এর শোধও আমি নেবো! আমার শারীরিক অবস্থারও আর খোঁজ নিতে পারবেন না! আমিও জানাবো না।ব লবো না আমারও শারিরীক অবস্থা – চিকিৎসার কথা। হুমায়ূন লিখেছে, মাস দেড় আগে ভাই ভাগনেদের দল নিয়ে ৩ দিনের জন্য সিলেট গিয়েছিলাম। আপনি নাকি প্রতিদিনই খবর নিতেন। কেমন আছি, কেমন খাচ্ছি। যত্ন আত্মি হচ্ছে কিনা! কে করবে এমনটা আর!
যখনই নিজ খরচায় বিদেশ গেছেন, আমিই তো ছিলাম আপনার ট্রাভেল এজেন্ট। ঢাকায় হাজারো ট্রাভেল সার্ভিস। কিন্তু চিটাগং থেকে আমাকেই বলতেন টিকেটের ব্যবস্থা করতে! কিন্তু শেষ টিকিটটা আমার অগোচরে করে চলে গেলেন! এটা কি ঠিক হলো!!
১৯৮০ সাল আমি চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের দ্বিতীয় মেয়াদের সাধারণ সম্পাদক। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের দ্বি-বার্ষিক সন্মেলন। এই প্রথম ঢাকার বাইরে এমন সম্মেলন। বিশাল আয়োজন। দেশের তাবৎ জাঁদরেল সাংবাদিকদের উপস্থিতি ছিল। সন্তোষ গুপ্ত, নির্মল সেন, হাবিবুর রহমান, গিয়াস কামাল, আহমেদ হুমায়ুন, আনোয়ার জাহিদ, আতিকুল আলম, গোলাম সারোয়ার থেকে শুরু করে রিয়াজ আহমদ, ইকবাল সোবহান সবাই। যতটুকু মনে পড়ে প্রায় অর্ধশতজন অংশ নিয়েছিলেন। সম্মেলনটি ছিল নির্বাচনী উত্তাপে মুখর।
একদিকে আহমদ হুমায়ন অন্যদিকে আনোয়ার জাহিদ। রমরমা ম্যান টু ম্যান প্রচারণা ছিল। আয়োজক হিসাবে ছিল আমার ব্যস্ততা। এবং আমি একজন মূল্যবান ভোটার। ৩ দিন ধরে চললো সম্মেলন। এ কদিন ঈগল চোখে শাহরিয়ার ভাই আমাকে আমাকে যাচাই করছিলেন চুপচাপ। পরে জেনেছি, তিনিই বলেছেন, অনেকেই নাকি তাকে বলেছেন আমাকে তার পছন্দের ক্যান্ডিডেটের পক্ষে আমাকে বলতে! না, তিনি বলেননি। কিন্তু নির্বাচনের পর তিনি আমাকে একপাশে ডেকে বললেন? আমাকে চেনো? – চিনি তো। ইত্তেফাকের চিফ রিপোর্টার। বিশাল ব্যাপার। যেন সংবাদপত্রের পিএম। এমন মর্যাদা বা ক্ষমতাধর! পরের বাক্যটি ছিল, ইত্তেফাকে কাজ করবে? আমি জাস্ট অবাক নেত্রে তাকালাম। অখ্যাত স্থানীয় দৈনিকের ৪৫০টাকার রিপোর্টার! তাকে বলা হচ্ছে, দেশের শ্রেষ্ট পত্রিকায় কাজ করবো কিনা। যোগ্যতা বাছ বিচার না করেই! গুরুত্ব না দিয়েই ‘সায়’ দিলাম।
বললেন, ঢাকায় গিয়েই আমার সাথে দেখা করবে। তারপর বেশ ক’মাস কেটে গেল। বার কতেক ঢাকা গিয়েছি। জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢু মারতাম। আঞ্চলিক নেতা হিসাবে মোটামুটি পাত্তা ছিল। একদিন হঠাৎই ক্লাব লবিতে শাহরিয়ার ভাইয়ের সাথে দেখা। বললেন, এই যে, তোমাকে না বলেছি আমার সাথে দেখা করতে? আমি কাতুমাতু করছিলাম। আসলে তার ঐ বলা আমার কাছে অকল্পনীয় আশ্বাস মনে হয়েছিল! তাই তা মনেও রাখিনি। বললেন, শোন কাল ১১টায় অফিসে আসবে একটা দরখাস্ত নিয়ে। তারপরেও বহু নাটকীয়তার মধ্যে তারই প্রত্যক্ষ আগ্রহে আমার উত্তেফাকে ২৬ বৎসরের পথ অতিক্রম।
শাহরিয়ার ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা পারিবারিক রূপ নেয় আরও এক যুগ পর। ‘৯১ এর ঘূর্ণিঝড় এবং রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটনাবলীর সরেজমিন রিপোর্টে তিনি গাইড করতেন। জগৎখ্যাত মার্কিন নিউজ উইক ম্যাগাজিনের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি আমার ছবি ব্যবহার করে আমাকে ক্রেডিটও দিয়েছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে খালিজ টাইমস্ এও। আমি এপি’তে কন্ট্রিবিউটর, স্ট্রিংগার রিপোর্টার হলাম। কাছাকাছি নামের আমার আর এক অনুপ্রেরণা অভিভাবক হাসান সাঈদের কারণে। পরিচয়ও করিয়েছেন হাসান শাহরিয়ার। তিনি খাতিরে টেনে তুলতেন না বরং চ্যালেঞ্জ নিতে ঠেলে দিতেন। সেখানেই থাকতো শেখার অবকাশ।
গেল বছর তাকে নিয়ে একটা প্রকাশনার তোড়জোড় চলছিল। এমন সময় একদিন সিলেটের হুমায়ন (উনার আত্নীয় এবং পরম স্নেহভাজন সিলেটের দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিনিধি) শাহরিয়ার ভাইয়ের বইটির জন্য আমার লেখা দিতে বললেন। আমি হতভম্ব প্রায়! তার সম্পর্কে আমার লেখা স্পর্ধা দেখানোর মতো। দেশ বিদেশের তাবৎ উঁচু কাতারের এবং বরেণ্য সব সাংবাদিক, লেখকরা তাকে নিয়ে লিখতে পারা সম্মানের মনে করে। আমি কোন ছাড! আমার সোজা উত্তর ছিল ‘ সম্ভব নয়’। হুমায়ূন কথাটা আবার একটু ঘুরিয়ে বলে আমাকে কুপোকাত করলেন। ‘শাহরিয়ার ভাই আশা করেন’। সেই রাতেই আমি লেখাটা রেডি করে পরদিন হুমায়ূনকে পাঠিয়ে বললাম; প্লিজ আগে পড়ে নেবেন। তারপর শাহরিয়ার ভাইকে দেখাবেন।
আমার লেখায় বইটির মান যেন ক্ষুন্ন না হয়। অনেক সংশয়ে ডরে ভয়ে ছিলাম। আমার লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘আমার আদর্শ আমার মেন্টর’। ‘বেশ ভালো’ তার এ মন্তব্যের মনে হলো বিরাট ভার হালকা হলো!
আমার জানা শোনার মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে আধুনিক, স্মার্ট এবং একজন ওপেন মাইন্ডেড সাংবাদিক। ছিলেন দারুণ সৌখিন। জুনিয়র বা তরুণ সহকর্মীদের তার মতো করে কাছে টানার উদারতা বিরল। তিনি প্রশংসা নিতে নয়; প্রশংসা করতেন বেশী। তার সৌখিনতার একটি ঘটনা বলি। ২০০৮ সালে সিজেএ’র কনফারেন্স শেষে আমরা দু’জন পোলান্ডের ওয়ারশে ৩ দিন কাটিয়ে ইটালীর রোমে ৩ দিন ও সিসিলিতে ২ দিন কাটিয়ে লন্ডন যাই। ওয়ারশতে ৫ তারকা ওয়েস্টিনে আমরা ২টি নরমাল সুপিরিয়র রুম বুক করেছিলাম। চেক ইন করার সময় রিসিপশন থেকে আমাদের বলা হলো ; একটা অফার চলছে ৫০ ইউরো বাডিয়ে দিলে টপ ফ্লোরে (২২ তলায়) সুপার ডিলাক্স রুম দেয়া যাবে। সেই ফ্লোরের জন্য পৃথক লবি, রেস্টুরেন্ট, ২৪ ঘণ্টা ফ্রি ফুড অ্যান্ড ড্রিন্ক সার্ভিস এবং ডেডিকেটেট এটেন্ডডেন্ট থাকবে।
শাহরিয়ার ভাই মুহূর্তও ভাবলেন না। বললেন ‘প্লিজ গো ফর ইট’। রোমে যখন গেলাম সে আর এক ঘটনা। তখন সন্ধ্যা প্রায়। আগেই ঐ শহরে থাকা আমার এক নিকটাত্মীয়কে দিয়ে প্রায় ৪ তারকা মানের একটি গেস্ট হাউজে রুম বুক করা হয়েছিল। রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখলেন বিছানার গা ঘেঁষা জানালা।বাথরুমের লকটা নড়বড়ে। তার পছন্দ হলো না। তিনি বেঁকে বসলেন। নাহ্ এখানে থাকা যাবে না। আমার আত্মীয় বললেন এডভান্স করা হয়েছে, কাল না হয় শিফট করি। তিনি বললেন, অসুবিধা কি ঐ একদিনের টাকা না হয় যাবে। কাছাকাছি কোন ভালো চেইন হোটেল দেখো। তাই হলো , প্রায় দ্বিগুণ রেইটের শেরাটন হোটেলেই উঠা হলো। এই হলো শাহরিয়ার ভাই। প্রায় দেখতাম চট্টগ্রামের কোন অনুষ্ঠানে এলে অন্যরা ট্রেনে বা প্লেনে আসলেও তিনি নিজ গাড়ি নিয়ে ছুটে আসতেন। তার কথা ছিল, বাহনের সময়ে চলার চেয়ে নিজের সময়ে বাহন চলাই আরামপ্রদ।আর যখনই বেড়ানো বা ছুটি কাটাতে যাওয়া হয়, তখন টোটালি রিলাক্সড মুডে থাকা উচিত। থাকা, খাওয়া, বলা, চলা সব কিছুতেই।
শাহরিয়ার ভাইকে আমি আমার সাংবাদিক জীবনের আদর্শ এবং মেন্টর বলে গর্ববোধ করি। তার কাছে কেবল সাংবাদিকতা নয়; সময়ের সাথে কিভাবে চলতে হয় তারও দীক্ষা পেয়েছি। কেবল কর্মে নয়, সাংগঠনিক কাজে এমনকি আপ্যায়নে পজেটিভ অ্যাটিচিউড আমাকে শিখিয়েছেন। ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম থেকে দি ডেইলী পিপলস্ ভিউ পুন প্রকাশকালে তিনি ছিলেন আমার প্রধান গাইড, অভিভাবক এবং পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক।