সম্মান জোর করে আদায় করা যায় না, আবার ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করেও তা পাওয়া যায় না। এটি মানুষের কাজ, আদর্শ ও চরিত্রের নিরব মূল্যায়নের ভিত্তিতে স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয়। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, জোর করে আদায় করা শ্রদ্ধা স্থায়ী হয় না, কিন্তু প্রকৃত সম্মান ঠিকই থেকে যায়।
বিএনপি চেয়ারপারসন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার গত ১৭ বছরের রাজনৈতিক জীবন এই সত্যের সাক্ষ্য বহন করে। প্রতিকূলতার মুখেও খালেদা জিয়ার অঙ্গীকার, সাহস ও দৃঢ়তা তাঁকে কোটি মানুষের হৃদয়ে সম্মানের আসনে বসিয়েছে।
শৈশব ও বাঁকবদল (১৯৪৫-১৯৭১)
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জলপাইগুড়িতে জন্ম খালেদা খানম পুতুলের। পরে তিনি জাতির কাছে পরিচিত হন বেগম খালেদা জিয়া নামে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। বাবা ইস্কান্দার মজুমদার ব্যবসায়ী, মা তৈয়বা মজুমদার ছিলেন গৃহিণী। তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয় দিনাজপুরের মিশন স্কুলে।
১৯৬০ সালের আগস্টে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানকে বিয়ে করেন। এই দম্পতি ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাস করেন। এরপর ঢাকায় ফিরে আসেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান আর্মি চট্টগ্রামে বর্বরোচিত হামলা চালায়। তখন মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। খালেদা জিয়া দুই শিশু সন্তান তারেক রহমান (৫) ও আরাফাত রহমান কোকো’কে (১ বছর ৫ মাস) নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে একা ছিলেন। সেখান থেকে তাকে গ্রেফতার করে সাড়ে পাঁচ মাস ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি রাখা হয়। তাঁর সেই দিনগুলো কাটে স্বামী হারানোর শঙ্কা আর সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা ও উৎকণ্ঠায়।
রাজনীতিতে অনিচ্ছাকৃত প্রবেশ
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খালেদা জিয়া পরিবার নিয়ে অনেকটাই নিভৃত জীবন যাপন করছিলেন। ১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলেও তিনি একজন গৃহিণীই থেকে যান এবং তাঁকে জনসমক্ষে খুব কমই দেখা যেত।
১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান খুন হওয়ার পর হঠাৎ করেই তাঁর এই জীবনে ছেদ পড়ে। বিএনপি গভীর সংকটে পড়লে দলের নেতৃত্ব কে দেবেন, তা নিয়ে কথা ওঠে। বিভিন্ন রাজনৈতিক বিবরণ অনুযায়ী— খালেদা জিয়া নিজে রাজনীতিতে কখনো আগ্রহী না হলেও তখনকার ক্ষমতাসীন মহল তার সম্ভাব্য প্রভাবকে ভয় পেত।
সাংবাদিক শফিক রেহমান তাঁকে সেই সময় ‘দুই ছেলেকে মানুষ করা নিয়ে ব্যস্ত এক লাজুক গৃহবধূ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তবুও রাজনৈতিক অস্থিরতার সেই সময়ে দলীয় নেতারা তাঁকে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য ক্রমাগত অনুরোধ করতে থাকেন।
গভীর শোক এবং রাজনৈতিক জীবনের কঠিন বাস্তবতা নিয়ে দ্বিধায় থাকার কারণে খালেদা জিয়া প্রথমে রাজনীতিতে আসতে চাননি। কিন্তু তাঁর ওপর চাপ বাড়তে থাকে। ১৯৮৩ সালের মার্চে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হন এবং পরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন এবং বিএনপিকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেন।
রাজনৈতিক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করলেও এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় খালেদা জিয়া এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত করেন।
মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘আজকে আমরা যে বিএনপি দেখি, তা খালেদা জিয়ার হাতেই গড়া।’
দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী
দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর নেতৃত্ব জনজীবনে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর তিন মেয়াদে তিনি বেশকিছু জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ বাস্তবায়ন করেন। এর মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন, দশম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন, স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ, বিদ্যুতায়ন ও নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা, সেলুলার এবং আইএসডি সেবার মাধ্যমে টেলিযোগাযোগের অগ্রগতি, ১ হাজারের বেশি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি বাড়াতে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ।
বেসরকারিকরণ বাড়ানো, আয়কর কমানো, আমদানি শুল্ক সহজ করা এবং মুক্তবাজার অর্থনীতিকে উৎসাহিত করে তিনি অর্থনীতিতে জিয়াউর রহমানের নীতিকে এগিয়ে নেন।
খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণেও কাজ করেছেন। তিনি ২০০১ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করেন, বীর প্রতীক তারামন বিবিকে সম্মাননা দেন এবং ২০০৬ সালে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের দেহাবশেষ দেশে ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের ব্যবস্থা করেন।
রাজনৈতিক অস্থিরতা
আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘদিন ধরে খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নিপীড়ন চালিয়েছে। ২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের মামলায় তাঁকে দণ্ডিত করা হয়। যা তাঁকে সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং ওই বছর জাতীয় নির্বাচনের সময় তিনি কারাগারেই ছিলেন। বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, এসব মামলা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন-পীড়ন, গণগ্রেফতার এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তোলে। এতে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
করোনাভাইরাস মহামারীকালে ২০২০ সালের মার্চে মানবিক কারণে তাঁর সাজা স্থগিত করা হয়। পরে তা ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পূর্ণ ক্ষমা পান। এরপর ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান এবং মে মাসে দেশে ফেরেন। তবে, শারীরিক দুর্বলতার কারণে তিনি আর সক্রিয় রাজনীতিতে ফেরেননি।
প্রতিরোধের উত্তরাধিকার
তাঁর সমর্থক ও লাখ লাখ সাধারণ মানুষের কাছে খালেদা জিয়া গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের এক মূর্ত প্রতীক। কারাজীবন, আইনি লড়াই এবং ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্টের মুখেও তিনি কখনো দমে যাননি।
তাঁর সমর্থকরা বিশ্বাস করেন, খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট গড়ে তুলতে, কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে এবং নারী নেতৃত্বে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।
একজন সাধারণ গৃহিণী থেকে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠার তাঁর এই যাত্রা স্থিতিস্থাপকতা, সাহস ও দৃঢ়তার এক গল্প। রাজনৈতিক উপাধির বাইরে তাঁর উত্তরাধিকার হলো— তিনি এই বার্তা রেখে গেছেন যে, সততা, অধ্যবসায় এবং সত্যের অন্বেষণ সবচেয়ে কঠিন ঝড়কেও মোকাবিলা করতে পারে।


