দ্যা মেইল বিডি / খবর সবসময়

; ;

দ্যা মেইল বিডি ডট কম

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিবন্ধিত অনলাইন পত্রিকা, নিবন্ধন নং- ১১

চব্বিশের জুলাই আন্দোলনের শেষ দিনগুলোতে কারফিউর দমবন্ধ পরিবেশে ঢাকা নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। ঠিক তখনই রায়েরবাজার কবরস্থানে আসতে শুরু করে একের পর এক নাম-পরিচয়হীন মরদেহ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের আহ্বায়ক এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (ইউট্যাব) মহাসচিব ড. মোর্শেদ হাসান খান তার ফেসবুক পেইজে ‘মৃত্যুতে নামহীন, স্মৃতিতে অম্লান’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ পোস্ট দেন। সেখানে তিনি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার সরকারের নির্দেশে নিষ্ঠুরতম বর্বরোচিত নিপীড়ন ও গণহত্যার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।

অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও গনঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী উদযাপনে গঠিত কমিটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন।

তিনি লিখেছেন, ‘কোনো সাইরেন বাজেনি, হয়নি কোনো শোকযাত্রা, কাঁদেনি কোনো স্বজন। প্রতিটি মরদেহ মোড়ানো ছিল সাদা কাপড়ে-পরিচয়হীন, নীরব। ছিল না কোনো মৃত্যুসনদ, হয়নি কোনো ময়নাতদন্ত। একটার পর একটা মরদেহ দ্রুত মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে, মুছে ফেলা হয়েছে তাদের অস্তিত্ব। ব্লক ৪-এর প্রতিটি কবরে গাঁথা ছিল কেবল একটি বাঁশের কঞ্চি।’

অধ্যাপক মোর্শেদ আরো লেখেন, ‘আন্দোলনে নিহত অন্তত ১১৪ জনকে রায়েরবাজারে কবর দেওয়া হয়েছিল, এর বেশিরভাগই ১৯ থেকে ২২ জুলাইয়ের মধ্যে, যখন ‘গুলি করার নির্দেশ’সহ কারফিউ জারি ছিল। তারা কেউ দুর্ঘটনার শিকার ছিলেন না, ছিলেন না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার। তারা ছিলেন আন্দোলনের শহীদ ছাত্র, শ্রমিক ও পথচারী, যাদের কবর দেওয়া হয়েছিল পরিচয়হীন অবস্থায়, কোনো কাগজপত্র ছাড়াই। অসংখ্য পরিবার তখন মরিয়া হয়ে খুঁজেছিল তাদের প্রিয়জনকে থানায়, হাসপাতালে, মর্গে; কিন্তু বারবার ফিরতে হয়েছে খালি হাতে।’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘এটি ছিল ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম রাখার এক নির্মম প্রয়াস। সরাসরি নির্দেশে দেশজুড়ে কারফিউ জারি হয়, দেওয়া হয় ‘গুলি করার অনুমতি’, বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক। তবুও ভয়কে উপেক্ষা করে প্রতিদিন রাস্তায় নেমেছিল সাহসী তরুণেরা। কিন্তু জবাব এসেছিল গুলিতে। প্রতিদিনই বাড়ছিল মৃতের সংখ্যা। হাসপাতালগুলো হয়ে উঠেছিল নীরব মর্গ, আর রায়েরবাজার হয়ে উঠেছিল নামহীন শহীদদের গোপন সমাধিস্থল।’

ড. মোর্শেদ হাসান উল্লেখ করেন, ‘এই মুছে ফেলা ছিল না কোনো ভুলবশত ঘটনা-এটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। মরদেহ ব্যবস্থাপনার যে ন্যূনতম নিয়ম ডকুমেন্টেশন, ডিএনএ নমুনা, ময়নাতদন্ত-সবকিছুই উপেক্ষা করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কীভাবে পুলিশ ভ্যানে তাড়াহুড়ো করে একসঙ্গে ১০ থেকে ১২টি মরদেহ এনে ফেলা হতো, সাদা কাপড়ে মোড়া, পরিচয়হীন। কবর খোঁড়ার শ্রমিকেরা নিঃশব্দেই সেগুলো একটির পর একটি লম্বা গর্তে মাটিচাপা দিতেন—প্রতিটি কবরে গাঁথা হতো কেবল একটি বাঁশের কঞ্চি।

কেবল কয়েক দিনের মধ্যেই এভাবে ডজনের পর ডজন মরদেহ মাটির নিচে হারিয়ে যায়। গোরখোদকদের ভাষায়, তাদের ওপর ছিল চাপ-চুপচাপ, দ্রুত সমাধি দিতে হবে।

এটি ছিল একটি সংগঠিত অপরাধের অংশ-একটি ‘হত্যা-যন্ত্র’, যা বেওয়ারিশ দাফনের আড়ালে মৃতদেরকে অদৃশ্য করে দিচ্ছিল।’

অধ্যাপক মোর্শেদ তার লেখায় কয়েকটি হৃদয়বিদারক ঘটনার কথাও তুলে ধরেন, যেখানে মায়ের হাতে কেবল ঝাপসা ছবিই ছিল প্রিয় সন্তানের শেষ স্মৃতি, কিংবা এক তিল দেখে কেউ চিনতে পেরেছিলেন নিজের সন্তানকে, অথচ তখন সেই দেহ ইতোমধ্যে ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে দাফন করা হয়েছে।

মোর্শেদ হাসান খানের বর্ণনায় জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের বাইরে এক মা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলেন, ছেলের একটি ঝাপসা ছবি হাতে। ঠিক আগের রাতে সেই মা হাসপাতালের এক কর্মচারীকে ঘুষ দিয়েছিলেন, যাতে অন্তত একবার হিমঘরে ঢুকে মরদেহগুলো দেখতে পারেন। যখন সেই কর্মচারী ফিরে এসে মাথা নাড়েন, তিনি সিঁড়িতে ঢলে পড়েন। ওই নারী চিৎকার করেন নি। চলেও যান নি। শুধু বসে থাকেন, ঘণ্টা নয়, দিনের পর দিন। আরেক মা কেবল একটি তিল দেখে বুঝেছিলেন, মৃতদেহটি তার ছেলের। কিন্তু সেই মরদেহও ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে কবর দেওয়া হয়ে যায়।

অধ্যাপক মোশের্দ হাসান লিখেছেন, এক নারী এসেছিলেন রায়েরবাজার কবরস্থানে, ভাঙা মোবাইল স্ক্রিনে ছিল তার ভাইয়ের ছবি। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করেন, এমন কাউকে কি তিনি দেখেছেন? দারোয়ান মুখ ফিরিয়ে একটি বাঁশের কঞ্চির সারির দিকে ইশারা করেন। ‘সেদিন বারোটা দেহ কবর দিয়েছিলাম,’ চাপা স্বরে বলেন তিনি।

সেখানে কোনো নাম ছিল না। কোনো তালিকা ছিল না। ছিল শুধু মাটির সারি আর খাড়া করে গাঁথা কঞ্চিগুলো। নারীটি তখন মোবাইলটা আরো শক্ত করে ধরেন, আর ফিসফিস করে বলেন, ‘সে তো শুধু ভিডিও করছিল।’ যখন একের পর এক মৃতদেহ হারিয়ে যেতে থাকে সেই গণকবরে, তখন পরিবারগুলো ছটফট করে একটিমাত্র খবরে আশায়, কিন্তু চারপাশে কারফিউ, বন্ধ যোগাযোগ, নেই কোনো আহত বা নিহতের তালিকা। মায়েরা মর্গের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাবারা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে বেড়ান। এই আশায়, হয়তো ছেলে এখনও ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে কবর দেওয়া হয়নি। কেউ কেউ আটক হন চেকপোস্টে, জেরা করা হয়, ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অধিকাংশ সময়ই জোটে কেবল হতাশা।

ঢাবি সাদা দলের এই নেতার ভাষায়, এটি শুধুই শোক নয়, এটি এক অসহনীয় নির্যাতন। মৃতদের পরিচয় অজ্ঞাত রেখে পরিবারগুলোকে বঞ্চিত করা হয়েছে ন্যায়, ক্ষতিপূরণ এবং ন্যূনতম সম্মান থেকে। আজও নেই কোনো সরকারি নথি, নেই কোনো ডিএনএ ব্যাংক, নেই নিখোঁজদের জাতীয় তালিকা। পরিবারগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে অদৃশ্য।

আন্তর্জাতিক মহলের কিছু কণ্ঠস্বর এ অমানবিক দাফন প্রক্রিয়ার নিন্দা জানিয়েছে এবং ন্যায়ের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

মোর্শেদ হাসান খান আরো বলেন, ‘আবারও আন্দোলনের ডাক উঠেছে, মৃতদের পরিচয় প্রকাশের দাবিতে। সামাজিক সংগঠনগুলো ডিএনএ পরীক্ষার দাবি জানিয়েছে। সাংবাদিকেরা কবরের নথিপত্র দেখতে চেয়েছে। পরিবারগুলো এখনও খুঁজছে। কিন্তু উত্তর এখনও অধরা।’

পোস্টের শেষ অংশে ঢাবি অধ্যাপক লিখেছেন, যারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে কিংবা নির্বাক থেকেছে, তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। নতুন সরকারের দায়িত্ব সত্যকে আলোর মুখে আনা, প্রতিটি কবর উন্মোচন করা, প্রতিটি দেহ শনাক্ত করা এবং প্রতিটি পরিবারকে জানানো তাদের প্রিয়জন কোথায় শায়িত আছেন। প্রতিটি মা জানার অধিকার রাখেন, তার সন্তান কোথায় ঘুমিয়ে আছে। এটি রাজনৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি একটি নৈতিক দায়।

তিনি আহ্বান জানান, আমাদের সংগ্রহ করতে হবে সেই নামগুলো, যেগুলো হারিয়ে গেছে নীরবতার আড়ালে। প্রতিটি নামহীন কবর হয়ে উঠুক একেকটি প্রশ্ন, যার উত্তর রাষ্ট্রকে দিতে হবে। প্রতিটি বাঁশের কঞ্চি শুধু মৃত আত্মার নয়, বরং উপরকার অপরাধের দিকেও ইঙ্গিত করে, যার বিচার এখনো হয়নি। এখনই সময় কাজ শুরু করার।

Share.
Leave A Reply

মোঃ আব্দুল আওয়াল হিমেল
প্রকাশক ও সম্পাদক 
দ্যা মেইল বিডি ডট কম
মোবাইল: +৮৮০ ১৩১৪-৫২৪৭৪৯
ইমেইল: themailbdnews@gmail.com
ঠিকানা: ১০২/ক, রোড নং-০৪, পিসি কালচার হাউজিং সোসাইটি, শ্যামলী, ঢাকা-১২০৭

নিউজরুম: +৮৮০ ১৩১৪-৫২৪৭৪৯
জরুরী প্রয়োজন অথবা টেকনিক্যাল সমস্যা: +৮৮০ ১৮৩৩-৩৭৫১৩৩

© 2025 Themailbd.com. Designed and developed by Saizul Amin.
Exit mobile version