নিজস্ব প্রতিবেদক: নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার নওপাড়া ইউনিয়নের কাউরাট ইটাচকি গ্রামের সেলিনা আক্তারের বাড়িতে এখন শুধু কান্নার ধ্বনি। আদরের ছোট ছেলে পলাশের মরদেহ ফেরত আসার অপেক্ষায় ভেঙে পড়েছেন তিনি। নয় মাস আগে জমি বিক্রি ও ধারদেনা করে পলাশকে পাঠানো হয়েছিলো সৌদি আরবে। উদ্দেশ্য ছিলো পরিবারের ভাগ্য ফেরানো। অথচ আজ সেই পলাশের মরদেহ ফেরত আনার সংগ্রাম চলছে।
রবিবার (২৭ এপ্রিল) পলাশের পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় কুতুবপুর গ্রামের প্রণয় নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে পলাশকে প্রবাসে পাঠানো হয়। দালাল প্রণয়ের আশ্বাস দিয়েছিল সৌদি আরবের একটি স্বনামধন্য কোম্পানিতে চাকরি হবে, নিয়মিত বেতন আসবে, বৈধ আকামা দেওয়া হবে। বাস্তবে পৌঁছে পলাশ পাননি কোনো চাকরির নিশ্চয়তা, নিয়মিত আয় বা আকামার নিশ্চয়তা। দিশেহারা হয়ে, হতাশা আর নিরাপত্তাহীনতার মাঝেই অবশেষে পলাম আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
গত শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) সৌদি আরবে অবস্থানরত পলাশের চাচাতো ভাই আল আমিনের মোবাইল ফোন কলের মাধ্যমে পরিবারের কাছে খবর আসে পলাশ আর নেই। এরপর থেকে পুরো পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
পলাশের মা সেলিনা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার পলাশ অনেক কষ্ট আর অপমান সয়ে মরেছে। আমি শুধু আমার ছেলের লাশটা ফেরত চাই।”
পলাশের বড় ভাই মো. রানা মিয়া ও চাচাতো ভাই মো. কায়কোবাদ বলেন, প্রণয় আমাদের কাছে বারবার আশ্বাস দিয়েছিলো, পলাশ ভালো থাকবে। কিন্তু বাস্তবে সে প্রতারণা করে ওর জীবনটাই নষ্ট করেছে। আমরা এ প্রতারকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
অভিযুক্ত প্রণয়ের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পলাশ কোম্পানিতে কাজ করছিলো এবং বেতনও পাচ্ছিলো। মাঝখানে অসুস্থ হয়ে ডাক্তার দেখিয়েছে। আমার সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো। পরিবারের অভিযোগ সঠিক নয়। মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি আরো জানান, এ বিষয়ে কিছু ডকুমেন্টস তিনি দেখাতে পারবেন।
এ বিষয়ে কেন্দুয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জানান মোবাইলে বলেন, ঘটনাটি সম্পর্কে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো অভিযোগ পাইনি। লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সরেজমিনে কাউরাট ইটাচকি গ্রামে গিয়ে জানা যায়, প্রণয়ের মাধ্যমে শুধু পলাশ নয়, এর আগে আরো কয়েকজনকে সৌদি আরবে পাঠানোর ঘটনা রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা প্রতিশ্রুত চাকরি পাননি বা ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। স্থানীয়ভাবে দালাল চক্রের এই তৎপরতা দীর্ঘদিনের, তবে ভুক্তভোগীরা হয় ভয়ের কারণে, নয়তো বিচারহীনতার কারণে মুখ খুলেন না।
এ ঘটনায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার নামে এই ধরনের প্রতারণা বন্ধ করতে সরকারের কঠোর নজরদারি ও দ্রুত বিচার কার্যক্রম প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
পলাশের স্বপ্নভঙ্গের এই করুণ পরিণতি আরেকবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—স্বপ্নের পেছনে ছুটে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে কত তরুণ অকালে ঝরে যাচ্ছে। প্রতারণার দায়ে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এ ধরনের মৃত্যুর মিছিল থামবে না।
পলাশের পরিবার এখন একটাই দাবি করছে, “আমাদের ছেলের লাশ ফেরত আসুক, আর প্রতারকের বিচার হোক।”