আর মাত্র ক’দিন পরেই আসছে ১৪ এপ্রিল বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। এ বৈশাখকে সামনে রেখে জেলার আত্রাইয়ের জামগ্রামের কাগজের ফুল তৈরির কারিগররা ব্যস্ত সময় পার করছেন।
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবে বৈশাখী মেলা। তবে কাগজের ফুল ছাড়া যেন পূর্ণতা পায় না এসব মেলায়। কারণ প্রিয়জনকে উপহার কিংবা ছোট্ট সোনামনিদের খেলনা; কাগজের ফুলের কোন তুলনা হয় না। আর তাই কাগজের ফুলের যোগান দিতে দিন-রাত নানান রঙের বাহারি কাগজ, কাপড় ও শোলা দিয়ে ফুল তৈরি করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন নওগাঁর আত্রাইয়ের জামগ্রামের ফুল কারিগররা। এ বৈশাখকে সামনে রেখে জামগ্রামের ফুলের কারিগররা স্টার, চর্কি, মানিক চাঁদ, গোলাপ, সূর্যমুখী, কিরণমালা, জবা, বিস্কুট, গাঁদাসহ বিভিন্ন নামের বাহারী নাম আর ডিজাইনে ফুল তৈরি করছেন। দেখে মনে হবে এক একটা সত্যিকারের ফুল।
আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে ওই গ্রামের ২-৩টি হিন্দু পরিবার এ ফুল তৈরির কাজ শুরু করেন। এখন তাদের হাত ধরে পুরো গ্রামের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস এ ফুল তৈরি। বর্তমানে ওই গ্রামের প্রায় ৪০০ পরিবার এ বাহারি ফুল তৈরির কাজে নিয়োজিত। সংসার দেখভাল করার পাশাপাশি গ্রামের নারী-পুরুষ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, ছোট-বড় সবাই এ ফুল তৈরি করার কাজ করে থাকেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবে বৈশাখী মেলা আর এ মেলাগুলোকে আরো বর্ণিল সাজে সাজাতে তাদের এ প্রাণান্তর চেষ্টা।
পাশাপাশি স্বাবলম্বী হচ্ছেন ফুল কারিগররা। আর তাই পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু করে রাত অবধি কাজ করে যাচ্ছেন ফুল তৈরির কারিগররা।
গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়বে বিভিন্ন স্থানে জটলা বেঁধে কয়েকজন মিলে তৈরি করছে এ ফুল । ফুল তৈরির পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেরি করে বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা। তবে পহেলা বৈশাখে এ ফুলের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। এছাড়া দুই ঈদে, বিভিন্ন পূজা ও মেলায়ও এ ফুল বিক্রি করা হয়। কেউবা কাপড়, কাগজ আর বাঁশসহ নানা উপকরণ দিয়ে সকাল থেকে রাত অবধি ফুল তৈরির কাজ করে চলেছেন। পরিবারের একজন নয়, ফুল তৈরির এ কাজ করছেন পরিবারের সবাই। বিশেষ করে বাড়ির নারীরা সংসারের কাজ-কর্ম সেরে তৈরি করছেন এসব ফুল। খুব বেশি পরিশ্রম না হলেও ধৈর্য সহকারে করতে হয় এ কাজগুলো। বাড়ির সবাই মিলে ফুল তৈরির পর পুরুষরা বিক্রির উদ্দেশ্যে চলে যায় জেলা ও জেলার বাহিরে। অর্থাৎ দেশের ৬৪ জেলাতে। সেখানে গিয়ে তারা ১৫-২০ দিন পর্যন্ত অবস্থান করে ফুলগুলো বিক্রি শেষ করে বাড়ি ফিরেন। এতে করে বাৎসরিক একটি বড় অংকের আয়ও করে থাকেন ফুলের কারিগররা।
জামগ্রামের ফুল কারিগর সুরুজ ইসলাম দুলু বাসস’কে বলেন, প্রথমে আমার দাদা, এরপর আমার বাবা। তারা গত হওয়ার পর আমিও দীর্ঘ ২০ বছর ধরে এ ফুল ব্যবসা করে আসছি। এসব ফুল তৈরির উপকরণ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আমদানি করা হয়। তারপর সেগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে ফুলে রূপান্তরিত করা হয়। এ ফুল তৈরির কাজে তার স্ত্রী ও দুই সন্তান সহযোগিতা করে থাকেন। পহেলা বৈশাখ আসার এক মাস আগে থেকে শুরু হয় এসব ফুল তৈরির কাজ।
ওই গ্রামের ফুলের কারিগর মনিরুল ইসলাম কানন বাসস’কে বলেন, তার বাবা এ ফুল তৈরি ও তৈরিকৃত ফুল বিভিন্ন জেলায় পাইকারী বিক্রির কাজ করতেন। সেই সুবাদে তিনিও এ কাজ করছেন। বর্তমানে তিনি, তার স্ত্রী, দুই সন্তান ও বাবা-মা যৌথভাবে সংসার করছেন। তবে এ ফুল তৈরি থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে অনেক স্বচ্ছলভাবেই দিন কেটে যায় তাদের। তারা সারা বছর এ কাজ করে থাকেন।
আমিনুল ইসলাম বুলু নামে এক ফুল ব্যবসায়ী বাসস’কে জানান, জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তিনি এ ফুল বিক্রির সাথে জড়িত। ফুলগুলো পার্শ্ববর্তী জয়পুরহাট, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া ও রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বসা বৈশাখী মেলাগুলোতে বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। যে এলাকায় যাওয়া হয় সেখানে তাবু খাটিয়ে নিজেদেরই রান্না-বান্না করে খেতে হয়। এরপর সব ফুল বিক্রি হয়ে গেলে আবার ফিরে আসেন। এতে করে পহেলা বৈশাখ, দুর্গাপূজাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মৌসুমভেদে লাভ হয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
ফুলের কারিগর আফরোজা বানু বাসস’কে বলেন, ফুল তৈরিতে পরিবারের গৃহিণীদের অবদান সবচেয়ে বেশি। সংসারের সব কাজ সম্পন্ন করে পরিবারের পুরুষদের এ ফুল তৈরিতে সাহায্য করি। তিনি আরো বলেন, সরকার থেকে বিনা অথবা স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলে আমাদের এ শিল্পটি আরো এগিয়ে যাবে।
আত্রাই মোল্লা আজাদ সরকারী কলেজের শিক্ষার্থী পূজা বাসস’কে বলেন, বাবা এ ফুলের ব্যবসা করে আমাদের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছেন। আমিও পড়ালেখার পাশাপাশি ফুলের কাজ করে পরিবারকে সাহায্য করে থাকি। এতে করে আমার হাত খরচ চলে যায়।
নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল বাসস’কে বলেন, এটি একটি ঐতিহ্যপূর্ণ শিল্প। যার কদর দেশজুড়ে। সৌখিন মানুষ ও শিশুদের কাছে এ বাহারি কৃত্রিম ফুলগুলোর চাহিদা অনেক বেশি। এ ফুল কারিগররা শুধু তাদের উপার্জনই নয়; বাংলার সকল সাংস্কৃতিক উৎসবকে বর্ণিল করতেও বিশেষভাবে ভূমিকা রাখছেন। এটা একটি ক্ষুদ্র কুটির শিল্প। আর এ শিল্পের তৈরি ফুল দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বিক্রি হচ্ছে। শুধু পহেলা বৈশাখ নয়, বিভিন্ন গ্রামীণ মেলার সৌন্দর্যবর্ধনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে এ জামগ্রামের ফুল। এর সঙ্গে জড়িত কারিগরদের জন্য উন্নতমানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাসহ স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করার আশ্বাস প্রদান করেন।