চার বছরের ছোট্ট ছেলে আবদুল আহাদকে হারিয়ে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগের বাসা ছেড়ে মিরপুরের একটি সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে উঠেছেন আহাদের বাবা-মা। ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবে সন্তানহারা হওয়ার পর রায়েরবাগের সেই বাসাটি তাদের কাছে এক বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
কিন্তু নতুন ঠিকানায় এসেও শোক যেন পিছু ছাড়ছে না তাদের। আহাদের মায়াভরা মুখ, তার হাসি-কান্না আর ছোট ছোট স্মৃতি প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াচ্ছে পুরো পরিবারকে।
‘ওর রক্তমাখা বীভৎস স্মৃতি বয়ে চলা সেই ফ্ল্যাটে আর থাকা সম্ভব ছিল না,’ বলছিলেন আহাদের শোকাকুল বাবা আবুল হাসান।
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে শহীদদের মধ্যে কনিষ্ঠতম হিসেবে ধরা হয় আবদুল আহাদকে। ১৯ জুলাই বিকেলে রায়েরবাগের ভাড়া বাসার বারান্দা থেকে রাস্তায় সংঘর্ষ দেখতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয় ছোট্ট আহাদ। ২০ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শাহাদাত বরণ করে এই নিষ্পাপ শিশু।
‘আমাদের মনের অবস্থা বোঝানোর ভাষা নেই। সন্তানহারা হওয়ার যন্ত্রণা কাউকে বোঝানো অসম্ভব,’ বলতে বলতে বাকরুদ্ধ হয়ে যান আবুল হাসান।
সেই ভয়াল দিনের কথা মনে করে হাসান বলেন, ‘সেদিন ছিল শুক্রবার, ১৯ জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আহাদের। আমাদের ১১ তলা বিল্ডিংয়ের নিচের রাস্তা থেকে আসছিল সেই আওয়াজ। আমরা তখন ৭ তলার ফ্ল্যাটে থাকতাম।’
‘ঘুম থেকে উঠে আহাদ বারান্দায় ছুটে গিয়ে বলল, বাবা বাবা দেখো, নিচে কী হচ্ছে! আমি আর আমার স্ত্রী কোহিনূর আক্তার সুমি বারান্দায় গিয়ে আহাদের পাশে দাঁড়াই,’ বলছিলেন স্মৃতিকাতর হাসান।
নিচে তখন উত্তেজনা তুঙ্গে। একপাশে ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা, অন্যপাশে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লোকজন—ছাত্রলীগ, যুবলীগ আর শ্রমিক লীগের কর্মীরা। একে অন্যকে লক্ষ্য করে ছোড়া হচ্ছিল ইট-পাটকেল।
‘আমরা দুই পক্ষের সেই তুমুল সংঘর্ষ দেখছিলাম। হঠাৎ গুলির শব্দ আর সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট আওয়াজে কেঁপে উঠল চারপাশ। তবে আশ্চর্যজনকভাবে কোনো পুলিশের উপস্থিতি চোখে পড়েনি তখন,’ বললেন হাসান।
‘হঠাৎ একটা গুলি এসে সোজা আমার ছেলের ডান চোখে বিদ্ধ হলো, আর ও লুটিয়ে পড়ল আমার সামনে,’ বলে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন ৩৫ বছর বয়সী আয়কর বিভাগের এই সিনিয়র সহকারী।
বিজয়নগরের অফিসে ছোট্ট একটা সোফায় বসে কথা বলছিলেন তিনি। পাশে বসে থাকা প্রতিবেদকের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
‘রক্তমাখা ছেলেকে কোলে নিয়ে আমরা কোনোভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যাই। তখনও শহরজুড়ে আতঙ্ক। মূল সড়ক এড়িয়ে গলিপথ ধরে রিকশায় করে হাসপাতালে পৌঁছাই,’ বললেন হাসান।
ঢামেকে ভর্তি করানো হয় আহাদকে। আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে তাকে। কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই জটিল ছিল যে, ব্রেনে গুলি অবস্থান করছে কি না তা নিশ্চিত করতে সিটি স্ক্যানও করা যায়নি। কারণ স্ক্যান করতে হলে লাইফ সাপোর্ট খুলতে হতো, যা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
‘পরে এক্স-রেতে দেখা গেল, গুলিটা ওর মাথায় বিঁধে আছে,’ বলেন হাসান।
পরদিন ২০ জুলাই রাত সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে ডাক্তার এসে জানিয়ে দিলেন, আহাদ আর নেই।
‘২১ জুলাই দুপুর ৩টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে আমার ছেলের নিথর দেহটা আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হলো,’ বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে আবুল হাসানের।
সেইদিনই ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার মানিকদাহ ইউনিয়নের পুকুরিয়া গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় আহাদকে।
‘গুলিটা কে ছুঁড়েছিল আমরা জানি না, কিন্তু যে দিক থেকে গুলি এসেছিল, সেই দিকটায় ছিল ছাত্রলীগ যুবলীগ আর শ্রমিক লীগের কর্মীদের অবস্থান,’ বললেন হাসান।
সেদিনই একই এলাকায় আরেকজন নিহত হন—মেরাজনগরের বাসিন্দা, ৪২ বছর বয়সী নির্মাণসামগ্রী ব্যবসায়ী মো. মাসুদ। আসরের নামাজ পড়তে বেরিয়ে দুই ছেলের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।
সেদিন আরটিভিতে সম্প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হেলমেট পরা দুই যুবক একটি দোকানের সামনে থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ছে। তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন নির্দেশ দিচ্ছে। সেই গুলির একটি লাগে মাসুদের মাথায়।
সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, মাসুদকে হত্যার আগে একই দলটিই গুলি করে হত্যা করেছিল ছোট্ট আহাদকে।
ছোট ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল আবুল হাসানের। বড় ছেলে মেহরাজ হাসান দিহান কচুখেতের একটি হাফেজি মাদ্রাসায় পড়ে। আহাদকেও হাফেজ বানানোর স্বপ্ন দেখতেন তিনি।
মোবাইলে থাকা একটি ভিডিও দেখিয়ে হাসান বলেন, ‘এই দেখেন, আহাদ সূরা ইখলাস পড়ছে। এত ছোট বয়সে কত সূরা মুখস্থ করেছিল আমার ছেলে।’
প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে আহাদ আয়াতুল কুরসি পড়ত আর মোবাইলে সূরা ফাতিহা শুনে ঘুমাত।
‘এখনও রাতে যখন সূরা ফাতিহা শুনি, মনে হয় আহাদ আমার পাশেই শুয়ে শুনছে,’ বলেন হাসান, কান্নাভেজা কণ্ঠে।
আহাদের মা কোহিনূর এখনও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। শোক সামলে উঠতে পারেননি এখনও।
‘রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না, সারারাত আহাদের ছবি আর খেলনা বুকে জড়িয়ে কাঁদে,’ বলেন হাসান।
আহাদের মা সুমি ফেসবুকে দুই ছেলের নামে একটি পেজ খুলেছেন—‘দিহান এন্ড আবদুল আহাদ টু ব্রাদার্স’। সেখানে প্রতিদিন আহাদের ছবি আর ভিডিও আপলোড করেন তিনি।
শিশু সন্তান হারানো এই দম্পতির একটাই চাওয়া—ন্যায়বিচার।
‘সরকার চাইলে খুব সহজেই কারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে তাদের খুঁজে বের করতে পারবে। আমরা হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই,’ বলেন আহাদের বাবা।