দুবাই পাসপোর্ট ও ভিসা উইয়ং অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কাজী ফয়সালকে প্রত্যাহার করার ১৮ দিন পার হলেও তিনি বহাল তবিয়তে অফিস করছেন। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল দুবাই (সংযুক্ত আরব আমিরাত) পাসপোর্ট ও ভিসা উইংয়ে কর্মরত প্রথম সচিব হিসেবে যোগদান করে মোহাম্মদ কাজী ফয়সাল কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করেছেন। অভিযোগ রয়েছে তাঁর অফিসের পাশেই একটি নির্দিষ্ট দোকান থেকে পাসপোর্টের আবদন করতে বাধ্য করা হয় আবেদনকারীকে। ওই দোকান থেকে তিনি প্রতিমাসে পারসেন্টিজ হিসেবে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। ওই দোকান ছাড়া অন্য দোকান থেকে আবেদন করলে, তা গ্রহণ করেন না ওই কর্মকর্তা। এছাড়াও গত জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র করার অভিযোগও রয়েছে কাজী ফয়সালের বিরুদ্ধে। দুবাইতে যারা আন্দোলন করেছিলেন, তাদের তালিকা করে পাসপোর্ট বাতিল ও গ্রেপ্তার করানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন এই কর্মকর্তা। অবশেষে দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তাকে দুবাই পাসপোর্ট ও ভিসা উইং অফিস থেকে তাকে প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির বলে এখনো বহাল তবিয়তে দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তা। এতে দুবাই প্রবাসী অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
লিখিত অভিযোগে জানা যায়, দুবাই ও উত্তর আমিরাতে অসংখ্য বাংলাদেশী প্রবাসী বসবাস করছেন। দেশের উন্নয়নে রেমিট্যান্স পাঠানোয় সংযুক্ত আরব আমিরাত সবার ওপরে। কিন্তু অসংখ্য প্রবাসীদের জন্য দুবাই পাসপোর্ট ও ভিসা উইং অফিসটি দুর্নীতির কারখানা বানিয়েছেন বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের সন্তান প্রথম সচিব মোহাম্মদ কাজী ফয়সাল। দুবাই ও উত্তর আমিরাতের প্রবাসীদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও ভিসা করার কাজে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তা। শেখ হাসিনার ঘনিষ্টজন হওয়ায় তাঁর দুর্নীতির বিষয়ে এতো দিন কেউ মুখ খুলেনি। গোপালগঞ্জে বাড়ির সুবাদে অদক্ষ এই কর্মকর্তা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। প্রবাসী বাংলাদেশীরা যখন সেবা নিতে যান, তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করে না কাজী ফয়সাল। কখনো দেখা করলে প্রবাসীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন তিনি। তিনি পাসপোর্ট অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেলেও সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন দুর্নীতি ও আওয়ামী লীগ সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে। দুবাই পাসপোর্ট ও ভিসা উইং অফিসকে তিনি আওয়ামী লীগের আরব আমিরাতের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতেন।
অভিযোগ রয়েছে তিনি যোগদানের পর থেকেই দুবাই পাসপোর্ট অফিসে বাংলাদেশী প্রবাসী যারা পাসপোর্ট ইস্যু করতে যান, তাদের জন্য কাজী ফয়সাল প্রথম শর্ত দিয়েছেন অফিসের পাশেই রাব্বাস নামের একটি টাইপিং সেন্টার থেকে আবেদন করতে হবে। এই টাইপিং সেন্টার থেকে আবেদন না করলে, তাকে অফিসের ভেতরেই প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। সামনের গার্ডকে আগে থেকেই কাগজপত্র চেক করে ডুকাতে বলে রাখেন দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তা। এ টাইপিং সেন্টার থেকে প্রতিদিন পাঁচ-ছয়শত আবেদন করা হয়। আবেদনকারীকে ৫০-৬০ দিরহাম করে টাইপিং চার্জ দিতে হয়। এই অর্থ থেকে কাজী ফয়সালকে দিতে হয় অর্ধেক টাকা ঘুষ। যার পরিমান প্রতিদিন চার-পাঁচ লাখ টাকা। মাসিক হিসেব অনুযায়ী এর পরিমান দাড়ায় এক কোটিও বেশি টাকা। এছাড়াও অফিসের নানা খ্যাত থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশীদের সেবা সহজীকরণের কথা বলে শেখ রেহানার নিকট আত্মীয়ের ‘ফসাওয়া গ্লোবাল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে পাসপোর্ট ও কনস্যুলার সার্ভিসের দায়িত্ব দেন। কিন্তু দুবাই পাসপোর্ট ও ভিসা উইং অফিসে পাসপোর্ট ইস্যুর জন্য পর্যাপ্ত জনবল রয়েছে। তারপরেও রাষ্ট্রীয় অতিগুরুত্বপূর্ণ এই সেবাটি অর্থের বিনিময়ে তিনি বাইরের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে করাতেন। যার বিনিময়ে তিনি ওই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৫ কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ করেছেন। কাজী ফয়সাল ২৭ ব্যাচের বিসিএস কর্মকর্তা। গোপালগঞ্জে বাড়ির সুবাদে তিনি দুবাই পাসপোর্ট ও ভিসা উইং অফিসে তদবির করে ঢোকেন। বিগত সরকারের প্রভাব দেখিয়ে গড়েছেন টাকার পাহার। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে বিগত জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার আন্দোলনেও ষড়যন্ত্র করেছিলেন। গত জুলাই মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে বিক্ষোভ হয়। সেই বিক্ষোভ দমনে কাজী ফয়সাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ওই সময় তিনি আইনশঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গেও যোগাযোগ রাখেন।
বিক্ষোভকারীদের তালিকা প্রস্তুত করে দুবাই পুলিশ ও সিআইডিকে সরবরাহ করেন। তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তারের জন্য সুপারিশও করেন। যার প্রেক্ষিতে কয়েকশ বাংলাদেশীকে আটক করা হয়। এর মধ্যে ৫৭ জনকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। তিনি আন্দোলনকারীদের পাসপোর্ট বাতিলের চেষ্টাও করেন। কিন্তু আন্দোলন তীব্র হওয়ায় তা পরেননি। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পরে তাঁর বিরুদ্ধে দুবাই ও উত্তর আমিরাতে বসবাসকারী বাংলাদেশী প্রবাসী ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমর্থনকারী সাকিবুল ইসলাম বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগের প্রেক্ষাপটে গত ২২ অক্টোবর তাকে দুবাই পাসপোর্ট ও ভিসা উইং অফিস থেকে প্রত্যাহার করে দেশে ফেরার জন্য নির্দেশ দেন বাংলাদেশ সচিবালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব মিঞা মুহাম্মদ আশরাফ রেজা ফরিদী। এরই প্রেক্ষিতে গত ৩০ অক্টোবর তাকে প্রত্যাহার করে বাংলাদেশ সচিবালয়ের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে যোগদান করার নির্দেশ দেন উপসচিব আফরোজা আক্তার রিবা। অথচ এই চিঠির ১৮ দিন পার হলেও তিনি বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এখনো তিনি স্বৈরশাসকের দোসড়দের অদৃশ্য শক্তির বলে নিয়মিত অফিস করে ঘুষ বাণিজ্য বহাল রেখেছেন। তাকে অবিলম্বে জরুরী নোটিশ দিয়ে প্রত্যাহার এবং তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূঔশ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন দুবাই ও উত্তর আমিরাতের প্রবাসী বাংলাদেশীরা।
এব্যাপারে তাঁর ব্যবহৃত ফোনে কলা করা হলেও তিনি তা ধরেননি।