‘শুট অন সাইট’ বা দেখামাত্রই গুলির নির্দেশ দিয়ে সরাসরি একটি গণহত্যায় অংশ নেয়া দলের পরিণতি হয় নিষিদ্ধ হওয়া নতুবা গণবিচারের মুখোমুখি হওয়া। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে অবধারিতভাবে দুটির একটি কিংবা উভয়টির মুখোমুখি হতে হবে। যেহেতু আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা পর্যাপ্ত অপরাধ করেছেন । বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের অপরাধগুলোকে তিনটা শ্রেণিতে বিভক্ত করা যাবে-
১। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বন্ধ কিংবা গণতন্ত্র হত্যা জনিত অপরাধ।
২। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন জনিত অপরাধ
৩। ছাত্র জনতার গণহত্যা সংশ্লিষ্ট অপরাধ
এজন্য তিনটি বিশেষ ট্রাইবুনাল হবে। দ্রুত বিচার নয়, নিয়মতান্ত্রিক কিন্তু ইফিশিয়েন্ট ট্রাইব্যুনাল।
প্রথম ধারার অপরাধের বিচারে ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বন্ধের বিচার ট্রাইব্যুনাল’ হবে। এখানে বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা তৈরি, মিছিলে সভা সমাবেশের হামলা, কার্যালয়ে তালা সহ যেকোনো বৈধ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বন্ধ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, সাংবাদিক নির্যাতন, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির জন্য একটি বিশেষ ট্রাইবুনাল প্রতিষ্ঠা করা হবে।
সকল বৈধ রাজনৈতিক দল নিধনে, ভাঙনে, বিদ্যমান দলের মিরর কিংস পার্টি করা, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হয়রানি হামলা মামলা জেল, গায়েবি মামলা, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে গুম খুন বিচারবহির্ভূত হত্যা তথা ক্রসফায়ার ইত্যাদির বিচার হবে এখানে। পাশাপাশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন, রাতের ভোটের নির্বাচন, ভোট জালিয়াতি ইত্যাদির বিচার হবে।
এখানে স্পষ্টভাবে বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে, এবং বিগত ১৫ বছরের সকল স্থানীয় নির্বাচনে মনোনয়ন প্রাপ্ত এবং মনোনয়ন প্রত্যাশীদের আগামী ১৫ বছর সব ধরনের জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যাবে। গণতন্ত্র হত্যার অপরাধে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৩ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া সকল আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের আগামী তিন টার্ম পর্যন্ত নির্বাচন নিষেধাজ্ঞা দেয়া যাবে।
দ্বিতীয় ধারার ট্রাইব্যুনালটি হবে নাগরিকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত মানবাধিকার বিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য। কাজটি বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে (আইসিটি) করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ট্রাইবুনালটির ত্রুটি গুলো শুধরিয়ে একে মানসম্পন্ন করতে হবে। এ ট্রাইবুনাল ভয়ের সংস্কৃতি বিস্তারে নাগরিকদের উপরে চালিত, নজরদারি হয়রানি ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন সহ সব ধরনের গুম খুন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার বিচার হবে।
তৃতীয় ট্রাইবুনালটি বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠা করা হবে ছাত্র জনতার গণহত্যার জন্য। কাজটি আইসিটির মাধ্যমে করা যেতে পারে, তবে অতীত বিতর্ক এবং ক্যাপাসিটি জনিত কারণে নতুন আরেকটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করাই ভালো।এটা জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নির্দেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের (প্রায় এক হাজার হত্যা) বিচার করবে। পাশাপাশি নিখোঁজ এবং আহত প্রায় ১৮ হাজার মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা তৈরি করবে।
অর্থাৎ গণতন্ত্র হত্যা, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ছাত্র জনতার গণহত্যার জন্য আওয়ামী লীগকে আলাদা আলাদা ট্রাইবুনালে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। বিচার প্রক্রিয়ার মান বজায় রাখতে সক্ষম হলে এই তিনটা ট্রাইবুনালের ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া যাবে। মান ধরে রাখা গেলে ডেমোক্রেটিক প্রসেস বন্ধ, গ্রস হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশন (এনফোর্স ডিজেপিয়ারেন্স এবং এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং) এবং ছাত্র জনতার গণহত্যা (কার্নেজ) প্রশ্নে যেকোনো বিচারে জাতিসংঘ সহ পশ্চিমাদের সরব এবং নিরব সহায়তা পাওয়া যাবে।
ধারণা করা যায়, এসব গণহত্যায় জড়িত আওয়ামী আমলাতন্ত্র, পুলিশ গোয়েন্দা সহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা অভিযুক্ত হয়ে পড়বেন। আমরা চাই বিচার প্রক্রিয়া গুলো ন্যায্যতা নিশ্চিত করে এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে দ্রুততার সাথে সম্পন্ন হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল চাই না। দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল অনেক সময় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সক্ষম হয় না।
চাইলে সাংবাদিক নির্যাতনের বিচারের জন্য আলাদা একটা ট্রাইব্যুনাল করা যেতে পারে। এর বাইরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সংগঠিত মেগা দুর্নীতি পাচার লুটপাট এবং রাষ্ট্রীয় তহবিলের অপচয় সংক্রান্ত ইসুগুলোকে দেশের স্বাভাবিক আইনের অধীনে বিচারকি প্রক্রিয়ায় নেয়া হবে।
তথ্য টেলিকম এবং আইসিটির উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের সুযোগ নেই। পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসানও একই বক্তব্য দিয়েছেন। যদিও আইন, সংস্কৃতি এবং প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী দল, তিনি ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয়। ড আসিফ নজরুলের বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া হলেও নাগরিক সমাজের কেউ কেউ মৌন কিংবা সরবভাবে তাঁর অবস্থানকে সমর্থনও করেছেন।
উপরে যে তিনটি বিচারকি ট্রাইবুনালের কথা বলেছি, এ তিনটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেলে আমি আশা করি আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ করার দরকার পড়বে না। যেহেতু আওয়ামী লীগ দলটির সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটা গভীর সংযোগ আছে, তাই ইতিহাসের কাঠগড়ায় রাজনৈতিক প্রশ্ন না উঠিয়ে বরং মানসম্পন্ন বিচারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে কৃত অপরাধের জন্য আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়া করানো কে আমি অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করি।
এরপরে দরকার হলে, জনতা চাইলে, গণআদালতে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করবে।
দুই
লেখক ও গবেষক জিয়া হাসান আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তিন ধরনের অ্যাকশন নিতে বলেছেন। এক- অর্থনৈতিক কাঠামোকে ভেঙ্গে দেওয়া। দুই- রাজনৈতিক কাঠামোকে ভেঙ্গে দেওয়া। তিন- ফ্যাসিস্ট চেতনা ইন্ডাস্ট্রিকে ভেঙ্গে দেওয়া।
আমি মনে করি, উপরোক্ত তিন ধরনের অপরাধের বিচার ক্যাটাগরিক্যালি এবং মানসম্পন্নভাবে করে আওয়ামী লীগের অপরাধীদের স্থানীয় এবং জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে নিয়ে গেলে তাদের রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে দেওয়া যাবে, এবং দলটি নিষিদ্ধের প্রয়োজন পড়বে না। এতে রাজনৈতিক বিতর্ক এড়ানো যাবে।
তবে আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে আমার ভিন্নমত আছে। অর্থনৈতিক কাঠামো না ভেঙে বরং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের থেকে নাশকতামূলক স্যাবোটাজ ফান্ডিং বন্ধ করার ফাইনানশিয়াল মনিটরিং এর পক্ষে আমি। আমি মনে করি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মালিকানাধীন শিল্প কারখানা এবং ব্যবসাগুলো জাতীয় সম্পদ। এসব তাদের পকেটের টাকায় নির্মিত হয়নি বরং হয়েছে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের টাকায়। এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা সহ সকল শিল্প উৎপাদনকে শতভাগ সচল রাখতে হবে। প্রয়োজনে শিল্প এবং ব্যবসায় অত্যন্ত দক্ষ প্রশাসক নিয়োগ করতে হবে। এমনভাবে, যাতে একটি ঘণ্টার জন্যেও ব্যবসা এবং শিল্প কারখানা এগুলোর উৎপাদন এবং কর্মকাণ্ড ব্যাহত না হয়। অপরাধী মালিকদের বিচার প্যারালালি চলবে। কোনো ব্যবসা ও শিল্প দখল হবে না। অর্থনীতিতে কোনো প্যানিক তৈরি করা যাবে না।
তবে হ্যাঁ, আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের লাগাম টানা জরুরি। জিয়া হাসান মনে করেন সাংস্কৃতিক ফ্যাসিস্টদের আয়ের সূত্র যাচাই, ‘ট্র্যাক এন্ড ট্রেইস’ কাজটা অনৈতিক মনে হইলেও বাস্তবে অনৈতিক না কেননা এরা নাগরিকদের সাদাকালো শিবিরে ভাগ করে গণতন্ত্র হত্যা অংশ নিয়ে মানবতা বিরোধী অপরাধ এবং স্বৈরাচারের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করেছে যা আদতে রাষ্ট্রবিরোধী। এই ফ্যাসিস্ট কাঠামো শেখ হাসিনার ক্ষমতার পাটাতন নির্মাণ করেছে। তাদের ফিনান্সিয়াল নেটওয়ার্ক ট্র্যাক করে দেখা যায়, এরা বিভিন্নভাবে ঋণখেলাপি সহ লুটপাটের অংশ ছিল। এদেরকে দৌড়ের উপরে রাখলে, এরা সামনে এসে বিষের ছোবল দিতে ভয় পাবে। এই মেশিনারি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্প এবং সাহিত্যকেও স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার প্রতীক করে তুলেছে।
আমি স্বৈরাচারী এবং ব্রামন্যবাদি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ঠেকাতে মব জাস্টিস চাই না, বরং আওয়ামী কালচার ও সংগঠনের বিপরীতে নতুন সক্ষম সংস্কৃতির বিকাশ চাই, নতুন সংগঠন চাই। আওয়ামী চেতনাবাদি সাংস্কৃতিক কর্মসূচির বিপরীতে মুক্ত এবং মননশীল অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসূচি চাই।
আমাদের সামনে এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আওয়ামী সুশীল সমাজ এবং তাদের এলিট পাওয়ার প্লেয়াররা, স্বৈরাচারী পাওয়ার নেক্সাসে নতুনদেরকে (গণঅভ্যুত্থানে উঠে আসা ছাত্র নেতৃত্ব) ভর্তি করবে না। এমতাবস্থায় এই এলিট পাওয়ার নেক্সাস ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি আমাদের উচিত হবে ‘নিউ সিটিজেন সোসাইটি’ তৈরি করা, নিউ মিডিয়া তৈরি করা, নিউ ইনটেলেকচুয়াল সোসাইটি তৈরি করা। যেখানে শহর এবং গ্রামের, পাহাড় এবং সমতলের, নারী এবং পুরুষের, ধর্ম কিংবা বর্ণের ভেদাভেদ থাকবে না। সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর অধিকার যেখানে সুনিশ্চিত থাকবে।
এভাবেই আমরা বিচারকি প্রক্রিয়ায়, অর্থনৈতিক ন্যায্যতায় এবং নতুন সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে নতুন সোসাইটি গড়ে আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শক্তিকে পরাজিত করে দিতে পারব। আমি কোনো শর্টকাট পথ চাই না, শর্টকাট পথ টেকসই নয়। গণঅভ্যুত্থান আজকের বাংলাদেশে একটি নতুন সচেতন নাগরিক সমাজ সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিকভাবে সচেতন এই জনগোষ্ঠীকে একটা ‘পলিটি’তে রূপ দিতে হবে। যেটা বাংলাদেশের মননশীল মানুষের সামষ্টিক সৌন্দর্যকে এবং সাধারণ নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষাকে নিপুণ দক্ষতার সাথে রাষ্ট্র গঠনে বিনিয়োগ করতে পারবে। তবেই হবে মুক্তি, যে মুক্তিকে ‘মুগ্ধ’ হবে ‘শহিদ আবু সাইদ’দের আত্মা!
মানবজমিনের প্রতিবেদন
লেখাঃ ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব