স্বীকৃতি বিশ্বাস, যশোরঃ

আজ হিন্দু সম্প্রদায়ের আরাধ্য ভগবান শ্রী কৃষ্ণের শুভ জন্মাষ্টমী। ভগবান শ্রী কৃষ্ণের জন্মতিথি।

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস সনাতন ধর্মের প্রবর্তক ও মহাবতার পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ৫ হাজার ২শত ৫১ বছর আগে দ্বাপর যুগে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন।

হিন্দু পঞ্জিকা মতে, সৌর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে যখন রোহিণী নক্ষত্রের প্রাধান্য হয়, তখন জন্মাষ্টমী পালিত হয়। উৎসবটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে প্রতি বছর মধ্য-আগস্ট থেকে মধ্য-সেপ্টেম্বরের মধ্যে কোনো এক সময়ে পড়ে।

এবছর জন্মাষ্টমী তিথি শুরু হবে২৬ আগষ্ট ( ৯ ভাদ্র)সোমবার সকাল ৯ টা ৫ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড, সমাপ্তি হবে ২৭ আগস্ট মঙ্গলবার সকাল ৭ টা ১৭ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডে।

শাস্ত্রে বলা হয়েছে–
“অরুণোদয়বিদ্ধস্ত সংত্যাজো হরিবাসরঃ। জন্মাষ্টম্যাদিকংসূর্যোদয়বিদ্ধং পরিত্যজেৎ।।”
(৮ম প্রমেয়-৯ শ্লোকে)

অর্থাৎ কেবলমাত্র শ্রীএকাদশীব্রতই অরুণোদয় পরিত্যাজ্য, পরন্তু জন্মাষ্টমী প্রভৃতি অন্য সমস্ত ব্রত মাত্র সূর্যোদয়বিদ্ধা হইলে ত্যাজ্য।

২৬ আগস্ট সোমবার সূর্যোদয় সকাল ৫ টা ৪৯ মিনিট (পঞ্জিকামতে)অষ্টমী শুরু হয়েছে সকাল ৯ টা ৫ মিনিট ৩৪ সেকেন্ডে।যেহেতু সোমবার সূর্যোদয়ের অনেক পর অষ্টমী শুরু হয়েছে সেহেতু ২৬ আগস্ট সোমার সপ্তমী বিদ্ধা হয়েছে। সূর্যোদয়বিদ্ধা হওয়ায় সোমবার জন্মাষ্টমীর ব্রতোপবাস পরিত্যাজ্য।

শ্রীহরিভক্তিবিলাস গ্রন্থে বলা হয়েছে—

“ইন্দুঃ পূর্বেইহনি জ্ঞে বা পরে চেদ্রোহিণী যুতা। কেবলা চাষ্টমী বৃদ্ধা সোপোষ্যা নবমী যুতা।।”
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস (১৫।৩৫৪)

পূর্ব দিবস যদিও সোমবার কি বুধবার হয়, কিন্তু শুক্লা অষ্টমী যদি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া পরদিন রোহিণীর সহিত সংযুত হয়, তাহা হইলে পরদিবস নবমীযুক্তা বৃদ্ধিগামিনী অষ্টমীতে উপবাস করিবে।

২৭ আগস্ট মঙ্গলবার সকাল ৭ টা ১৭ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডে পর্যন্ত অষ্টমী আর সূর্যোদয় সকাল ৫ টা ৪৯ মিনিট (পঞ্জিকামতে)। যেহেতু ২৭ আগস্ট মঙ্গলবার সূর্যোদয়কালীন অষ্টমী তিথি বর্তমান অর্থাৎ অষ্টমী তিথি উদয়গামী হয়েছে সেহেতু জন্মাষ্টমীর ব্রতোপবাস আগামী ২৭ আগস্ট মঙ্গলবার এবং পারণ ২৮ আগস্ট বুধবার সকাল ১০ টা ৩ মিনিটের মধ্যে।

শাস্ত্রীয় বিবরণ ও জ্যোতিষ গণনার ভিত্তিতে এবং লোকবিশ্বাস অনুযায়ী কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল খ্রীষ্টপূর্ব ৩২২৮ সালে ১৮ অথবা ২১ জুলাই মথুরা নগরীতে অত্যাচারী রাজা কংসের কারাগারে। তিনি বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম পুত্র। তার পিতামাতা উভয়ের যাদববংশীয়।

দেবকীর দাদা কংস, তাদের পিতা উগ্রসেনকে বন্দী করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। একটি দৈববাণীর মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন যে,দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের হাতে তার মৃত্যু হবে। এই কথা শুনে তিনি দেবকী ও বসুদেবকে কারারুদ্ধ করেন এবং তাদের প্রথম ছয় পুত্রকে হত্যা করেন। দেবকী তার সপ্তম গর্ভ রোহিণীকে প্রদান করলে বলরামের জন্ম হয়।

এরপরই কৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন। কৃষ্ণের জীবন বিপন্ন জেনে জন্মরাত্রেই দৈবসহায়তায় কারাগার থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বসুদেব তাকে গোকুলে তার পালক মাতাপিতা যশোদা ও নন্দের কাছে রেখে আসেন। কৃষ্ণ ছাড়া বসুদেবের আরও দুই সন্তানের প্রাণরক্ষা হয়েছিল।

প্রথমজন বলরাম (যিনি বসুদেবের প্রথমা স্ত্রী রোহিণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন) এবং সুভদ্রা (বসুদেব ও রোহিণীর কন্যা, যিনি বলরাম ও কৃষ্ণের অনেক পরে জন্মগ্রহণ করেন)।ঘোর অমানিশার অন্ধকারে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করায় কৃষ্ণের গায়ের রং শ্যামল। অন্য অর্থে ধূসর, পীত, কিংবা কালো। সংস্কৃত কৃষ্ণ শব্দটির অর্থ কালো, ঘন বা ঘন-নীল। কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

সমগ্র ভারতবর্ষে যখন হানাহানি, রক্তপাত, সংঘর্ষ, রাজ্যলোভে রাজন্যবর্গের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ তথা পৃথিবী যখন মর্মাহত, পাশে অবনত, ঠিক সেই সময় সৃষ্টি স্থিতি-প্রলয়ের যুগ সন্ধিক্ষণে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে পড়ে। অত্যাচারী ও দুর্জনের বিরুদ্ধে শান্তিপ্রিয় সাধুজনের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কংসের কারাগারে জন্ম নেন তিনি। শিষ্টের পালন ও দুষ্টের দমনে তিনি ব্রতী ছিলেন। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাই ভগবানের আসনে অধিষ্ঠিত শ্রীকৃষ্ণ।

কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী ব্রতের তাৎপর্যঃ পৃথিবীতে কংসের ক্রমবর্ধমান অত্যাচারের অবসান এবং ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। এইদিনটিই জন্মাষ্টমী হিসেবে পালিত। কৃষ্ণকে শ্রী হরি বিষ্ণুর সবচেয়ে অপরূপ অবতার বলে মনে করা হয়।

এমনটা বিশ্বাস করা হয় যে , জন্মাষ্টমীতে কৃষ্ণের পুজো করলে অকাল মৃত্যুর ভয় থাকে না এবং পরকালে স্বর্গে স্থান হয়। শ্রীকৃষ্ণের আরাধনায় জগতের সকল সুখ লাভ হয়। সন্তানের মঙ্গলের জন্য এই দিনে কৃষ্ণ পুজো করেন অনেকে। বিশ্বাস করা হয়, যাঁরা জন্মাষ্টমীতে বালগোপালকে মাখন, মিছরি, নিবেদন করা হয়।

শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলাকে কেন্দ্র করেই জন্মাষ্টমী উৎসব পালিত হয়। দেশের হিন্দু সম্প্রদায় ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে জন্মাষ্টমী পালন করেন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version