মহামারী থেকে ইউক্রেন সংকট পর্যন্ত, বিশ্ব গত ৮০ বছরের মধ্যে এক নজিরবিহীন দুর্বল এবং ভঙ্গুর কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সিঙ্গাপুরের সিনিয়র মন্ত্রী থারমান শানমুগারত্নম এই পরিস্থিতিকে এক দীর্ঘ ঝড়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। নিরন্তর কাঠামোর পরিবর্তন ভঙ্গুরতার একটি নতুন যুগ তৈরি করেছে বলে মনে করেন থারম্যান। ৯ মার্চ IMAS-ব্লুমবার্গ ইনভেস্টমেন্ট কনফারেন্স ২০২২-এ বক্তব্য রাখার সময় থারমান অনিশ্চয়তার একটি লম্বা তালিকার দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। যেখানে জায়গা করে নিয়েছে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন, স্থবিরতার হুমকি, ওমিক্রন বৈকল্পিক, জলবায়ু সংকট এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা। সিঙ্গাপুরের মনিটারি অথরিটি (এমএএস) এর চেয়ারম্যান থারম্যান – এর মতে , “ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ করা অনেক বেশি জটিল খেলায় পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতি প্রাক-মহামারীর চেয়ে আরও খারাপ। ”থারম্যান বলেছেন, ‘[ইউক্রেনের পরিস্থিতি এমন একটি সিস্টেমের বিচ্ছেদকে প্রতিনিধিত্ব করে যা একসময় বিশ্বব্যাপী স্থিতিশীলতাকে নিয়ন্ত্রণ করত।
হতে পারে সেই সিস্টেম হয়তো পুরো নিখুঁত ছিল না, তবে একটা ভারসাম্যের পরিবেশ ছিল। যেখানে এখন বড় একটি ফাটল তৈরী রয়েছে।” থারম্যান বিশ্বাস করেন যে ইউক্রেনের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, এবং যুদ্ধের জেরে উদ্ভুত ফলাফলগুলির কোনওটিই বিশ্বকে ভাল জায়গায় নিয়ে যাবে না। অবশ্যই, সবচেয়ে কঠিন আঘাত আসবে ইউক্রেনের ওপর। মানুষের খরচ দিন দিন বেড়ে যাবে। দেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামোর ধ্বংস যুদ্ধের পরে একটি গুরুতর বিষয় হতে চলেছে। ইউক্রেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ব্যাপক বাহ্যিক সমর্থন আশা করতে পারে, তবে রাশিয়া যেকোন পরিস্থিতিতেই তাকে হ্রাস করতে চাইবে , বলছেন থারম্যান। সেই সঙ্গে তিনি যোগ করেন , যুদ্ধের জেরে রাশিয়ার অর্থনীতি মারাত্মক মন্দার মধ্য দিয়ে যেতে চলেছে। এটি অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে দেশের মর্যাদা হ্রাস করবে এবং রাশিয়াকে আরো বিচ্ছিন্ন করে তুলবে। শুধুমাত্র পশ্চিমি নিষেধাজ্ঞার জন্য নয়। বিশ্বজুড়ে ব্যবসায়িক সংগঠন এবং নাগরিকরা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে । রাশিয়া থেকে বিনিয়োগকারীরা চলে যাচ্ছেন। পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে রাশিয়ার ব্যবসায়িক সম্পর্ক পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। থারমান রাশিয়ার কম বয়সী জনসংখ্যার দেশত্যাগের দিকেও ইঙ্গিত করেছেন। তাঁর মতে ,দুর্বল বিনিয়োগ, প্রযুক্তিতে দুর্বল অ্যাক্সেস এবং ব্রেন ড্রেনের প্রভাব দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করতে পারে ।
‘১৯৭৩ সালের চেয়েও খারাপ স্ট্যাগফ্লেশন’
থারম্যান বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলির কাছে প্রবৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একটি জটিল কাজ হতে চলেছে । সুদের হার স্বাভাবিককরণের দিকে নিয়ে যাওয়া কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ হতে চলেছে। যদিও আর্থিক খাত ইতিমধ্যে ইউএস ফেডের হার বৃদ্ধির প্রভাবের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তবে প্রত্যাশিত ফল অনেক খারাপ হতে পারে।থারম্যান বিশ্বাস করেন যে ধাক্কা আসতে চলেছে তা ১৯৭০ এর কুখ্যাত স্থবিরতাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। যা শুধু শক্তি ক্ষেত্রে নয় -খাদ্য, শিল্প সবক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলতে চলেছে। আসন্ন ধাক্কাটি বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলেও প্রভাব ফেলে গোটা সিস্টেমকে ব্যাহত করবে।
জীবাশ্ম জ্বালানি এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের পরিমাণ সরকারগুলির পক্ষে বহন করা মুশকিল , এতে আগামী তিন দশকের জন্য প্রতি বছর প্রায় ৩,৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রয়োজন । থারম্যান বলছেন, এটিকে কোনো বেসরকারী খাত বা বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া যাবে না। পাবলিক সেক্টরের উপরও নির্ভর করা যাবে না কারণ পাবলিক সেক্টরে সেই সংস্থানগুলি নেই। থারম্যান কার্বন ট্যাক্স এবং কার্বন মূল্য নির্ধারণের উপায় বাতলেছেন , যা কিছু সরকারি – বেসরকারি খাতকে সবুজ হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। সেই সঙ্গে তাঁর পরামর্শ , ”সরকারের নেতৃত্বের জন্য অপেক্ষা না করে বাজারগুলোকে নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে। যদিও কোনো সরকার ভাবতে পারে না যে বাজার একাই এর সমাধান করতে যাচ্ছে। এর জন্য পাবলিক সেক্টরের অংশগ্রহণ এবং ট্যাক্স এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামোর স্পষ্টতা প্রয়োজন।”জলবায়ু সংকটও শক্তি নিরাপত্তার সাথে ক্রমবর্ধমানভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে এবং থারম্যান বলেছেন, একটি ছাড়া অন্যটির সমাধান করা আর সম্ভব নয়।ইউক্রেন যুদ্ধ সেই চিন্তাকে আরো জোরালো করে তুলেছে। অপ্রীতিকর সত্যটি হল যে স্বল্পমেয়াদে, ইউরোপ এবং বিশ্বের রাশিয়ান সরবরাহের পরিবর্তে তেল এবং গ্যাসের আরও সরবরাহকারীর প্রয়োজন হবে। তিনি যোগ করেন: “আলো নিভে যাওয়া ঠেকাতে তেল, গ্যাস এবং কয়লার প্রয়োজন হবে… সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া আমরা এই সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হব না। কারণ তেল, গ্যাস এবং কয়লার উপর অত্যধিক নির্ভরতা বৃদ্ধি আমাদের অন্যকোনো বিকল্প খোঁজার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমাদের প্রচেষ্টা আরো দ্বিগুন করতে হবে। বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কাছে অনেকটা অক্সিজেনের মতো। আপনার কাছে থাকাকালীন আপনি এটির প্রয়োজন বুঝতে পারবেন না। আপনি উপলব্ধি করবেন তখন যখন এটি আপনার কাছে থাকবে না। আর তাই গোটা বিশ্ব এখন ঝড়ের মুখে দাঁড়িয়ে ।”
সূত্র : www.theedgesingapore.com