দ্যা মেইল বিডি / খবর সবসময়

; ;

দ্যা মেইল বিডি ডট কম

তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিবন্ধিত অনলাইন পত্রিকা, নিবন্ধন নং- ১১

ডিপ্লোম্যাসি। বাংলায় আমরা বলি কূটনীতি। আসলে বাংলায় কূটনীতি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘কূটানীতি’ থেকে এসেছে। প্রথম মৌর্য্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের উপদেষ্টা চাণক্যর (কৌটিল্য হিসেবে পরিচিত) নাম থেকে ‘কূটানীতি’ শব্দটির উদ্ভব। ডিপ্লোম্যাসির জন্ম হয়েছে প্রাচীন গ্রীক শব্দ থেকে । ১৭৯৬ সনে অ্যাডমন বার্ক প্রচলিত ফরাসি শব্দ Diplomatie থেকে চালু হয়। তবে কেউ কেউ ধারণা করেন, গ্রীক ‘ডিপ্লোমা’ শব্দ থেকে ডিপ্লোম্যাসি শব্দটির সৃষ্টি। কূটনীতির ইতিহাসে ফরাসি কূটনীতিক চার্লস মাউরিস দ্য ট্যালেয়ারেন্ড পেরীগোর্ড হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন কূটনীতিক।

সাধারণত কূটনীতি হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিদ্যার একটি শাখা। যেখানে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক চুক্তি বা আলোচনা সম্পর্কিত কলাকৌশল অধ্যায়ন করা হয়।

সাধারণ অর্থে কূটনীতি হচ্ছে, কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত সরকারি কার্যক্রম। বলা হয়ে থাকে, একটি রাষ্ট্র কেমন তার অনেকখানি নির্ভর করে সে রাষ্ট্রের কূটনীতির ধরনের ওপর। বাংলাদেশ এক সময় ছিল ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। দরিদ্রতা ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস লেগেই থাকতো। কূটনীতির সুযোগই বা কি ছিল? আর এখন বাংলাদেশ বিশ্বের একটি অর্থনৈতিক শক্তি। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। নিকট প্রতিবেশী ভারত একটি আঞ্চলিক শক্তি। বাংলাদেশের ডিপ্লোম্যাসি ছিল একসময় ভারতকেন্দ্রীক। বিশ্বে তেমন বিস্তৃত ছিল না। বিশ্ব রাজনীতিতে এখন চারটি শক্তি। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারত। জোটভুক্ত ইউরোপ আরেকটি শক্তি। সবার সঙ্গে সমান সম্পর্ক রাখা বা ভারসাম্য বজায় রাখা খুবই কঠিন কাজ।

প্রেসিডেন্ট বুশ ক্ষমতায় এসে কূটনীতির সংজ্ঞা পাল্টে দেন। তার ভাষায়- With us or without us. অর্থাৎ আমার সঙ্গে থাকলে বন্ধু, বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে শত্রু। বুশের এই সংলাপ মেনে বহু দেশ কূটনীতিতে দেউলিয়া হয়ে গেছে। বাংলাদেশ আসলে কোথায়? অভিজ্ঞ কূটনীতিকরা বলে থাকেন, একদা বাংলাদেশের বিউটি ছিল কূটনীতি। এখন রাজনীতি সামনে এসেছে। কূটনীতি চলে গেছে পর্দার আড়ালে। তাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেকটা হিমশিম খাচ্ছেন বাংলাদেশি কূটনীতিকরা। মোটাদাগে এটা ঠিক, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করাটা কূটনীতিকদের কাজ। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত হতে হবে অত্যন্ত কৌশলী। সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে এটা সম্ভব।

সাম্প্রতিককালে আমরা এর ব্যত্যয় দেখছি। সকাল-বিকেল সিদ্ধান্ত পরিবর্তন রাজনীতিতে সম্ভব। কূটনীতিতে শুধু বেমানানই নয়, বিপজ্জনকও বটে। কূটনীতিতে প্রতিটি শব্দ, এমনকি দাড়ি-কমা, সেমিকোলনও মনিটর হয়। সময়ের পরিবর্তনে এখন কিছু বলে ফিরিয়ে নেয়া যায় না। বলা যায় না- আমি বলিনি। মুহূর্তেই চাউর হয়ে যায় দেশ- বিদেশে। পরিণত হয় শব্দবোমায়। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি। মেলাকাল কূটনৈতিক রিপোর্টার ছিলাম। ইত্তেফাকের স্বর্ণযুগে এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বহু পেশাদার কূটনীতিকের সঙ্গে আমার সখ্যতা ছিল, বন্ধুত্ব ছিল। অনেক ঘটনা আজও প্রকাশ করিনি। করা ঠিকও নয়। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে এর প্রভাব পড়তে পারে।

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জমানায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এআরএস দোহা। এরশাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। চীন সফরে যাবেন এরশাদ। সম্ভবত ১৯৮২ সনের শেষদিকে। কৌতূহলবশত এআরএস দোহার সাক্ষাৎকার নেয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলাম। দোহা রাজি হয়ে গেলেন। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাংলাদেশের বন্ধু কারা? ছটফটে, অত্যন্ত স্মার্ট এআরএস দোহা বললেন, মুসলিম বিশ্বই আমাদের প্রথম বন্ধু। দ্বিতীয় বন্ধু চীনসহ প্রতিবেশী দেশসমূহ। তৃতীয়স্থানে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ। ৮২ সনের ২৪শে নভেম্বর ইত্তেফাকে এই সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়।

কূটনীতিতে এভাবে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সংজ্ঞায়িত করা যায় না। ক্যাটাগরি ভাগ করা যায় না। দোহা বোধকরি সেটা জানতেন না। পরদিন ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয় বন্ধু রাষ্ট্রসমূহে। বিশেষ করে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে। এরশাদের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার মেজর জেনারেল চিশতি আমাকে ডেকে পাঠালেন তার দপ্তরে। রুমে ঢুকতেই- কি লিখেছেন? দোহা সাহেব তো অস্বীকার করছেন। তাই নাকি! আমার কাছে টেপ রয়েছে। এই নিন সে টেপ। যেখানে দোহা সাহেব আরও অনেক কথা বলেছেন যা আমি ছাপিনি। সবকিছু ছাপা যায় না। চিশতি ব্যাপারটা বুঝে রক্তচক্ষু দেখাননি। লাল টেলিফোনে এরশাদকে পুরো ঘটনা জানালেন। এরপর মুক্তি পেলাম। তবে এজেন্সি পিছু ছাড়লো না। ড. একে আব্দুল মোমেন। শিক্ষক কাম কূটনীতিক। সজ্জন ব্যক্তি। খোলামেলা মানুষ।

এক সময় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন। ২০১৮-এর নির্বাচনে তিনি এমপি হয়েছেন। তার খোলামেলা বয়ানের জন্য কখনো প্রশংসিত, কখনো সমালোচিত। অতি-সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাব যেভাবে তিনি নাকচ করেছেন, তা দেখে ওয়াকিবহাল কূটনীতিকরা লজ্জায় মুখ ঢেকেছেন। কয়েক হাজার আফগান নাগরিককে যুক্তরাষ্ট্র সাময়িকালের জন্য ঢাকায় আশ্রয় দেয়ার প্রস্তাব করেছিল। প্রস্তাব তারা দিতেই পারে। আমরা গ্রহণ করতে পারি কিংবা নাও পারি। সাধারণ কূটনীতি হচ্ছে, সম্ভব না হলে কূটনৈতিক চ্যানেলে অপারগতা প্রকাশ করা কিংবা ঝুলিয়ে রাখা। এভাবে জনসমক্ষে নাকচ করার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। আছে বিপদের আশঙ্কা।

অভিজ্ঞ কূটনীতিক মাসুদ বিন মোমেন খুব ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলারের কাছে। কাকপক্ষীও জানতে পারেনি কি কথা হয়েছে দু’জনের মধ্যে। কিন্তু সব ফাঁস করে দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমেন। যেটা নিয়ে সরকারের ভেতরেই তোলপাড় হচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, রাষ্ট্রদূত মিলার পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক শেষে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে বার্তা পাঠানোর আগেই মোমেন নিজেই মিডিয়ার কাছে বলে দেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে আমাদের সায় নেই। বিদেশে অবস্থান করছেন এমন একজন সাবেক কূটনীতিকের ভাষায়- সব প্রকাশ করে দেয়া যদি কূটনীতি হয়ে থাকে তাহলে বলব, মোমেন সাহেব একশ’তে একশ’ পাবেন। কিন্তু এটা কোনো ডিপ্লোম্যাসি নয়। এভাবে প্রস্তাব নাকচ করে কি বার্তা দিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী? পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম দুপুরে কথা বললেন আফগান ইস্যুতে। মন্ত্রী মিডিয়াকে বড়জোর বলতে পারতেন নতুন কিছু নেই।

প্রতিমন্ত্রী যা বলেছেন এটাই আমাদের কথা। অথবা কোনো বিষয়েই মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতেন। তা না করে অন্য একটি দেশকে নিয়ে হাসি-মশকরা করেছেন। টেনে এনেছেন রোহিঙ্গা ইস্যু। এটা ঠিক, রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আর্থিক সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কথা রাখেনি। যুক্তরাষ্ট্র এখনো সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে অন্যদের কাতারে ফেলে দিয়ে বিচার করলে যৌক্তিক হবে না, এটা মন্ত্রীর না বুঝার কথা নয়। মন্ত্রীর বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র বিব্রত। কোনো মন্তব্য আসেনি পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে।

এরশাদের শাসনকালে পাঁচজন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হয়েছিল। আখেরে প্রমাণিত হয়েছে, সেটা ছিল এক ভুল সিদ্ধান্ত। অন্যকে খুশি করতে গিয়ে এরশাদ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এত দূরে না গিয়ে নিকট অতীতের একটি ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সরকারি সিদ্ধান্ত এবং ডিপ্লোম্যাসি সঠিক ছিল। ইয়েমেনবিরোধী সৌদি জোটে বাংলাদেশের নৈতিক সমর্থন ছিল। কিন্তু সৈন্য পাঠাতে রাজি হয়নি বর্তমান সরকার। এখানে প্রাধান্য পেয়েছিল কূটনীতি। আরেকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করতেই হয়, অতি-সম্প্রতি একজন বৃটিশ দূতকে ঢাকার বিদেশ মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। তলব কূটনীতিতে নতুন বা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। ভেতরের আলোচনা প্রেস রিলিজ দিয়ে জানানোর মধ্যে আনন্দ থাকতে পারে, কিন্তু মূল্য দেয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এর কিছুটা আঁচ আমরা ইতিমধ্যেই টের পাচ্ছি।

বৃটিশ সরকার লাল তালিকা থেকে করোনাক্রান্ত ভারত ও পাকিস্তানকে বাদ দিয়েছে। বাংলাদেশ এখনও রেডজোনে। অব্যাহত কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পরও কোনো ফল আসেনি। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশ সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চায়। চীন-ভারত সম্পর্কের টানাপড়েনে বাংলাদেশ এখন ভারসাম্যের কূটনীতি বেছে নিয়েছে। কখনো ভারতের দিকে কখনো চীনের দিকে। সামান্য ভুল হলেই ভারসাম্যের কূটনীতি নতুন সংকটের জন্ম দিতে পারে। বাংলাদেশের উন্নয়নে চীনের ভূমিকা অনস্বীকার্য । বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে ভারতের ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। এটা সবার জানা। নয় বছর আগে আমি আমার ‘কূটনীতির অন্দরমহল’ বইতে লিখেছিলাম, পররাষ্ট্রনীতি আর কিছুই নয়, এটি আসলে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটি বর্ধিতাংশ। বাংলাদেশের অস্থির, ভঙ্গুর, গণতন্ত্র ও রাজনীতি মনে রাখলে তার বৈদেশিক নীতির দোদুল্যমান অবস্থা আঁচ করে নিতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। যেমনটা আমরা দেখছি ভ্যাকসিন কূটনীতিতে।

চীনের সঙ্গে ভ্যাকসিনের দাম নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়। একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা চুক্তির ধারা লঙ্ঘন করে দাম প্রকাশ করেছিলেন। পরিণতিতে ওএসডি হয়েছেন। এই নিয়ে যখন দুই দেশের মধ্যে পত্র চালাচালি হচ্ছিল মাঝপথে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন দুঃখ প্রকাশ করে বসেন প্রকাশ্যে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে “স্বামী-স্ত্রী” সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করেন। যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রল হচ্ছে। জাতিসংঘ বাংলাদেশের গুমের বিষয়ে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত-আমেরিকার উদাহরণ টানেন। বলেন, ওসব দেশেও গুম হয়, কিন্তু জাতিসংঘ কথা বলে না। ওরা আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে।

এখানে উল্লেখ করা যায় যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পেশাদারী কূটনীতির মান বর্তমানে দেশের অন্য পাঁচটা সেক্টর থেকে ভিন্ন কিছু নয়। অনেকেই বলছেন, এর মান নিম্নমুখী। দলীয় দূষণে জেরবার পেশাদারিত্ব। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না আমাদের কূটনীতি অবশ্যই কৌশলী, বুদ্ধিদীপ্ত ও জ্ঞানসম্মত হতে হবে। মনে রাখা দরকার, পরিবর্তিত বিশ্বে কূটনীতিই কেবল বাংলাদেশকে সামনের কাতারে রাখতে পারে।

Share.
Leave A Reply

মোঃ আব্দুল আওাল হিমেল
প্রকাশক ও সম্পাদক 
দ্যা মেইল বিডি ডট কম
মোবাইল: +৮৮০ ১৩১৪-৫২৪৭৪৯
ইমেইল: themailbdnews@gmail.com
ঠিকানা: ১০২/ক, রোড নং-০৪, পিসি কালচার হাউজিং সোসাইটি, শ্যামলী, ঢাকা-১২০৭

নিউজরুম: +৮৮০ ১৩১৪-৫২৪৭৪৯
জরুরী প্রয়োজন অথবা টেকনিক্যাল সমস্যা: +৮৮০ ১৮৩৩-৩৭৫১৩৩

© 2024 Themailbd.com. Designed and developed by Saizul Amin.
Exit mobile version