দ্যা মেইল বিডি / খবর সবসময়

; ;

দ্যা মেইল বিডি ডট কম

তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিবন্ধিত অনলাইন পত্রিকা, নিবন্ধন নং- ১১

ভারতের পবিত্রতম নদী গঙ্গায় যেন গত কিছুদিন ধরে লাশ উপচে পড়ছে। শতশত লাশ গঙ্গার স্রোতে ভেসে এসেছে অথবা এর তীরে বালিতে চাপা দেওয়া অবস্থায় পাওয়া গেছে।

উত্তর প্রদেশের যেসব জায়গায় নদীর তীরে এই দৃশ্য দেখা গেছে, সেখানকার মানুষের ধারণা- এগুলো কোভিড-১৯ এ মারা যাওয়া মানুষের লাশ। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারত প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভারতে এ পর্যন্ত আড়াই কোটি মানুষের সংক্রমণ ধরা পড়েছে এবং মারা গেছেন ২ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে এই ভাইরাসে মোট মৃত্যুর সংখ্যা আসলে এর কয়েকগুণ বেশি।

নদীর তীরে খুঁজে পাওয়া মরদেহ, দিনরাত ২৪ ঘণ্টা জ্বলতে থাকা চিতাগুলো এবং শ্মশানগুলোতে জায়গার অভাব- এসব কিছু থেকে ভারতে মোট মৃত্যুর এমন একটি সংখ্যার আভাস পাওয়া যায়, যেটি সরকারি পরিসংখ্যানে স্বীকার করা হচ্ছে না।

উত্তর প্রদেশের সবচেয়ে বেশি সংকটজনক অবস্থা যেসব জেলায়, সেখানকার স্থানীয় রিপোর্টার, সরকারি কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। গঙ্গায় ভেসে আসা এসব লাশের পেছনে লুকিয়ে আছে সনাতনী বিশ্বাস, দারিদ্র্য আর এমন এক ভয়ংকর মহামারির গল্প- যা এখন বিদ্যুৎগতিতে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।

 

বিস্তীর্ণ নদীচরে যখন কেবল সমাধি

উত্তর প্রদেশের এই ভয়ংকর চিত্র প্রথম প্রকাশ পায় গত ১০ মে, যখন ৭১টি লাশ বিহার সীমান্তের কাছে চাউসা গ্রামের নদী তীরে ভেসে আসে।

চাউসা গ্রামটি বাক্সার জেলায়, সেখানকার পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট নীরাজ কুমার সিং বিবিসিকে বলেন, পচে যাওয়া এসব লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে, এগুলোর ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে এবং এরপর নদী তীরের গর্তে এগুলো কবর দেওয়া হয়েছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, নদীতীরে লাশ দাহ করার পর যেসব দেহখণ্ড পড়ে ছিল, সেগুলোই হয়তো নদীতে ভেসে গিয়েছিল, কিছু দেহাবশেষ হয়তো এরকম কিছু। তবে তাদের সন্দেহ লাশগুলো হয়তো নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এরকম ভেসে আসা আরও লাশ আটকানোর জন্য পুলিশ নদীতে একটি জালও পেতেছে।

এর একদিন পর, চাউসা গ্রাম হতে ছয় মাইল দূরে উত্তর প্রদেশের গাজিপুর জেলার গাহমার গ্রামের কাছে নদী তীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায় একেবারে পচে যাওয়া কয়েক ডজন বিকৃত লাশ। বেওয়ারিশ কুকুর এবং কাকের খাদ্য হয়ে উঠেছিল এসব মৃতদেহ।

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, কয়েকদিন ধরেই নদী তীরে এরকম লাশ ভেসে আসছিল, এখান থেকে যে পচা গন্ধ ছড়াচ্ছিল সেটির ব্যাপারে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাদের অভিযোগ আমলে নেননি। এরপর যখন গঙ্গার ভাটিতে বিহারে অনেক লাশ পাওয়ার খবর সংবাদ শিরোনাম হলো, তখনই কেবল কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসল।

পাশের জেলা বালিয়াতেও ঘটল একই ঘটনা। সেখানে গ্রামবাসীরা যখন গঙ্গায় সকালে স্নান করতে গেলেন, তখন দেখলেন ডজন ডজন পচে ফুলে ওঠা লাশ নদীতে ভাসছে। ভারতের হিন্দুস্থান পত্রিকার খবর অনুযায়ী পুলিশ ৬২টি লাশ উদ্ধার করে।

কান্নাউজ, কানপুর, উন্নাও এবং প্রয়াগরাজে নদীর তটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বহু অগভীর কবর। কান্নাউজের মেহন্দি ঘাটের তীর থেকে বিবিসির কাছে পাঠানো এক ভিডিওতে দেখা যায়, মানুষের শরীরের আকৃতির সমান বহু ঢিবি। অনেকগুলো দেখতে নদীর চড়ায় ফুলে উঠা কিছুর মতো, কিন্তু এগুলোর প্রতিটিতেই লুকিয়ে আছে একটি করে মরদেহ। কাছের মাহদেভি ঘাটে অন্তত ৫০টি দেহ খুঁজে পাওয়া গেছে।

মৃত্যুর সংখ্যায় ব্যাপক গরমিল

ভারতে হিন্দু ধর্মীয় রীতিতে সাধারণত মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। তবে অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘জলপ্রবাহ’ বলে একটি রীতিও প্রচলিত। শিশু, অবিবাহিত মেয়ে কিংবা সংক্রামক রোগে বা সাপের কামড়ে মারা যাওয়া কোনো ব্যক্তির লাশ নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয় এই রীতিতে।

অনেক দরিদ্র পরিবার লাশ দাহ করার আর্থিক সামর্থ্য রাখে না। কাজেই তারা প্রিয়জনের দেহ সাদা মসলিন কাপড়ে মুড়ে নদীতে ফেলে দেন। অনেক সময় লাশের সঙ্গে পাথর বেঁধে দেওয়া হয়, যাতে এটি পানিতে ডুবে যায়। কিন্তু অনেক লাশ এমনিতেই পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। স্বাভাবিক সময়েও গঙ্গায় লাশ ভেসে আসার ঘটনা বিরল কোনো দৃশ্য নয়।

তবে যেটা বিরল, তা হলো এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি সংখ্যায় লাশ ভেসে আসার ঘটনা। কানপুরের একজন সাংবাদিক বিবিসিকে জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ এ মৃতের সরকারি সংখ্যার সঙ্গে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যায় একটা বিরাট গরমিল আছে, এসব মৃতদেহ তারই প্রমাণ।

তিনি বলেন, সরকারি হিসাবে কানপুরে ১৬ এপ্রিল হতে ৫ মে পর্যন্ত ১৯৬ জন মারা গেছে, কিন্তু সাতটি ক্রিমেটোরিয়ামের হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে, সেখানে ৮ হাজার লাশ দাহ করা হয়েছে।

“এপ্রিল মাসে সব ক্রিমেটোরিয়াম দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা চলছিল। কিন্তু সেটাও যথেষ্ট ছিল না। কাজেই প্রশাসন ক্রিমেটোরিয়ামের বাইরের খোলা মাটিতে কাঠ দিয়ে লাশ পোড়ানোর ব্যবস্থা করে”, বলছেন তিনি।

“কিন্তু তারা কেবল সেসব লাশই গ্রহণ করছিল যেগুলো হাসপাতাল থেকে কোভিড-১৯ এ মারা গেছে বলে সার্টিফিকেট ছিল। অথচ বিরাট সংখ্যায় রোগী মারা যাচ্ছিল বাড়িতে, যাদের কোন টেস্ট পর্যন্ত করা হয়নি। এদের পরিবার লাশ নিয়ে গেছে শহরের বাইরে কিংবা পাশের জেলা উন্নাওতে। যখন তারা কোন চিতার ব্যবস্থা করতে পারেনি বা দাহ করার জন্য কাঠ পায়নি, তখন নদীর চরে নিয়ে লাশ চাপা দিয়ে রেখেছে।”

প্রয়াগরাজের একজন সাংবাদিক বলেন, তার বিশ্বাস বেশিরভাগ লাশ সেরকম মানুষের, যারা ঘরে কোভিড-১৯ এ মারা গেছেন কোন রকমের পরীক্ষা ছাড়া, অথবা যারা গরীব, লাশ দাহ করার সামর্থ্য পর্যন্ত নেই।

দিনরাত অবিরাম কবর দেওয়ার কাজ

নদী তীরে এসব কবর এবং তার মধ্যে পচা লাশ যখন খুঁজে পাওয়া গেল, সেটা যেন নদী বরাবর গ্রামগুলোতে বিরাট আতংক ছড়িয়ে দিল। কারণ তাদের আশঙ্কা এসব লাশ থেকে হয়তো তাদের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে।

গঙ্গার উৎপত্তি হিমালয়ে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদীগুলোর একটি। হিন্দুদের কাছে এই নদী খুবই পবিত্র। তাদের বিশ্বাস এই নদীর পানিতে স্নান করলে তাদের পাপ ধুয়ে যায়। এই নদীর পানি তারা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্যও ব্যবহার করে।

কান্নাউজের ৬৩ বছর বয়সী জগমোহন তিওয়ারি স্থানীয় একটি টিভি চ্যানেলকে বলেন, তিনি নদীর চড়ায় দেড়শ-দুশো কবর দেখেছেন। “সকাল সাতটা হতে রাত এগারোটা পর্যন্ত সেখানে কবর দেয়া হচ্ছিল। “এটা ছিল হৃদয় ভেঙ্গে যাওয়ার মতো একটা দৃশ্য”, বলছেন তিনি।

এসব কবর আবিষ্কৃত হওয়ার পর এলাকায় আতংক ছড়িয়ে পড়ে। লোকজনের ভয় ছিল, নদী তীরে কোনরকমে মাটি চাপা দেয়া এসব লাশ যখন বৃষ্টি হবে বা নদীর পানি বাড়বে, তখন স্রোতে ভেসে যাবে।

গত বুধবার রাজ্য সরকার এরকম ‘জল প্রবাহ’ নিষিদ্ধ করেছে। একই সঙ্গে যেসব গরীব পরিবার লাশ দাহ করার সামর্থ্য রাখে না, তাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছে। অনেক জায়গাতেই পুলিশ নদী হতে লাঠি দিয়ে লাশ টেনে তুলছিল এবং নদীতে মাঝিদের সাহায্য নিয়ে এসব লাশ তীরে টেনে আনছিল। সেখানে এসব লাশ খাদে ফেলে কবর দেওয়া হয় অথবা চিতায় তুলে দাহ করা হয়।

বালিয়া জেলার পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট ভিপিন টাডা বলেন, তারা গ্রাম পঞ্চায়েতের নেতাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন যেন নদীতে লাশ ভাসিয়ে না দেওয়ার জন্য তাদের সচেতন করা যায়। যাদের লাশ দাহ করার সামর্থ্য নেই, তারা যেন আর্থিক সাহায্যের জন্য আবেদন করে।

গাজীপুর জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মঙ্গলা প্রসাদ সিং বিবিসিকে বলেন, পুলিশের দল এখন নদীতীরে এবং শ্মশানঘাটে টহল দিচ্ছে। যাতে কেউ নদীতে লাশ ফেলতে না পারে বা নদীতীরে কবর দিতে না পারে।

কিন্তু তার দল এখনো প্রতিদিন নদীতে দুই একটা লাশ খুঁজে পাচ্ছেন।

Share.
Leave A Reply

মোঃ আব্দুল আওাল হিমেল
প্রকাশক ও সম্পাদক 
দ্যা মেইল বিডি ডট কম
মোবাইল: +৮৮০ ১৩১৪-৫২৪৭৪৯
ইমেইল: themailbdnews@gmail.com
ঠিকানা: ১০২/ক, রোড নং-০৪, পিসি কালচার হাউজিং সোসাইটি, শ্যামলী, ঢাকা-১২০৭

নিউজরুম: +৮৮০ ১৩১৪-৫২৪৭৪৯
জরুরী প্রয়োজন অথবা টেকনিক্যাল সমস্যা: +৮৮০ ১৮৩৩-৩৭৫১৩৩

© 2024 Themailbd.com. Designed and developed by Saizul Amin.
Exit mobile version