সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্টারের ছবি এবার অনেককেই শেয়ার করতে দেখেছি। মুহম্মদ খসরুর আঁকা মঙ্গল শোভাযাত্রার এই পোস্টারটি ১৩৯৭ সনের। ইংরেজি সনের হিসাবে ১৯৯০। স্বৈরাচার বিদায়ের বছর।
মুদ্রণের হরফে সেই পোস্টারে বড় করে লেখা, ‘মৃত্যু নয়, ধ্বংস নয়, নহে বিচ্ছেদের ভয়’। ঠিক একুশ বছর পর এবারের বৈশাখে এর চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কোন কবিতার লাইন খুঁছে পাচ্ছি না। যখন প্রতিদিনই কোনো না কোন স্বজন হারাবার ব্যথা নিয়ে নির্ঘূম রাত কাটাতে হচ্ছে। সকালে জেগে কাকে হারাবো এই ভয়ে দিন শুরু করতে হচ্ছে।
দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর হয়ে ওঠেছে, করোনায় মৃত্যু আর আক্রান্তের রেকর্ড।
প্রায় প্রতিদিনই নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিত্বদের চলে যাওয়া হয়ে ওঠেছে জীবনের অনুসঙ্গ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই অতিমারি নিয়ে নিশ্চয়ই আরও জীবনঘনিষ্ট ব্যথাতুর কিছু রচনা করতেন।
‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগলো যে দোল।’ আবার ফিরছি কবিগুরুর লাইনেই। ফি বছর বৈশাখে সকলেই গৃহের দ্বার বন্ধ করেছেন এবার খুলবেন বলে। বলা হয়েছে শীতে করোনা বাড়ে আর গরমে কমে। হলো উল্টো। এখন গরমে দেখছি বাড়ছেই না, চারপাশে মরক লেগে গেছে। গ্রাফ কেবলই ঊর্ধমুখি।
বিশে^র সবশেষ পরিস্থিতি অনুযায়ী করোনার হালখাতায় দেখা যাচ্ছে, আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ কোটি ৮৮ লাখ ১৫ হাজার ৫৫৪ জন। আর করোনায় লড়ে হার মেনেছেন ২৯ লাখ ৪৬ হাজার ১১৮ জন। বাংলাদেশ বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই। যদিও পাশর্^বর্তী দেশ ভারত এই দৌঁড়ে এগিয়ে বিশে^র সবচেয়ে বেশি সংক্রমনশীল দেশের প্রথম তিনে ওঠে এসেছে। মৃত্যু আর সংক্রমণে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল আর ভারতে আগপিছ হচ্ছে। ভারতে গতকাল একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছে, ১ লাখ ৮৪ হাজার জন। এরমধ্যে খুব নিকটতম পশ্চিমবঙ্গে চলছে নির্বাচনী হাওয়া। এ এক তামশা বৈকি। আমাদের এখানেও নানা উৎসবে করোনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে।
কতোটা ঝুঁকিতে আমরা এর ওপরই এবারের বৈশাখের হালখাতা লেখা চলছে। আফ্রিকান আর ইউকে ভ্যারিয়েন্টে তছনছ বাংলাদেশ। ব্রাজিলের ভ্যারিয়েন্টও আসি আসি করছে। প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যু আর সংক্রমণ। সবশেষ গ্রাফ অনুযায়ী বাংলাদেশে গতকাল মৃত্যু হয়েছে ৯৬ জনের। আশঙ্কা হচ্ছে এই সংখ্যা সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে।
কিন্তু সব চাপিয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে এই হিসাব কতোটা সঠিক অথবা কতোটা পূর্ণাঙ্গ। গতকাল আমার যে স্বজন মারা গেলেন তার হিসাব তো কেউ রাখেনি? কারণ, সরকার নির্ধারিত হাসাপাতালের বাইরে প্রচুর বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিদিনই অনেক রোগী মারা যাচ্ছেন যাদের নাম এই তালিকায় নেই। এভাবে চলে যাওয়াদের সংখ্যা যুক্ত করলে মৃত্যু ও সনাক্ত আরও বহুগুণ বেশি।
এই মৃত্যু আর আক্রান্তের বাড়ন্ত অবস্থায়ও মানুষ লাগামহীন। শপিংমল আর মার্কেটে চোখ রাখলেই তা স্পষ্ট। লকডাউন মানেই যেনো ঈদ ছুটি। সবাইকে বাড়ি যেতে হবে। সুতরাং, করোনাকেও সকলে মিলে নিয়ে যাচ্ছে গ্রামে আবার ফেরার সময় নিয়ে আসবে শহরে। এ এক তথৈবচ চিত্র। প্রশাসন চোখে কালো চশমা পরে মজা দেখছে।
বাংলাদেশে লকডাউন কি? গেল লকডাউনে একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল, তাতে দেখা গেছে একজন পুকুরে লাফ দেয়ার সময় বাতাসে তার লুঙ্গি উড়ে গেছে। লকডাউনের নতুন নতুন ব্যাখ্যা হাজির করা হচ্ছে। মহল্লায় রাস্তার শুরুতে বাঁশ দিয়ে পথ আটকানোই নাকি লকডাউন। সর্বাত্মক লক ডাউনে প্রধান সড়কেও দেখা যাচ্ছে বাঁশ দিয়ে আটকে দেয়ার দৃশ্য। ভেতরে যা খুশি হোক। রাস্তাতো বন্ধ। অবশ্য সরকার বলছে ভিন্ন কথা। এটা লকডাউন নয়, বিধিনিষেধ। কিন্তু তা যদি কেউ না মানেন তাহলে কি হবে?
বলা হচ্ছে, জীবন আর জীবিকার সমন্বয়ের কথা। সীমিত পরিসর নিয়ে খোদ বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, এটি ভেক টার্ম। আর অন্যদিকে লকডাউন শব্দটিই আমাদের অভিধানে এসে হয়ে গেছে ক্লিশে। এখন কড়াকড়ি আরোপ করতে হলে নতুন কিছু ভাবতে হবে। সরকার যদিও অনেকটাই উট পাখির মতো আচরণ করছে। মাটির নিচে মাথা গুঁজে সবকিছু সামাল দেয়ার কথা ভাবছে।
গেল বছরে যেখানে স্বাস্থ্যখাত প্রস্তুত নেয়ার কথা করোনা সামলাতে সেখানে টুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। কোটি কোটি টাকায় বানানো হাসপাতাল হয়ে গেছে গায়েব। আর নতুন বানানোর নামে বরাদ্দ বাড়ছেই। সাধারণ মানুষ মাত্রই এটি অন্তত বুঝে এভাবেই টাকা নয়ছয় হয়।
এবারের বৈশাখে পান্তা ইলিশের রসনা হারিয়েছে। ছায়ানট তার ঐতিহ্য নিয়ে ঠাঁই নিয়েছে ভার্চ্যুয়ালে। সকলেই পুরোনো ছবিতে সয়লাব করেছেন সামাজিক মাধ্যম। আর হতাশার সুরে বলছেন, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম?
এবারের বৈশাখের হালখাতা এসবেই পূর্ণ হবে। কতজনা স্বজন হারা হবেন? কীভাবে বেকারত্ব গুছাবেন? সামনের বছরেও এমনটাই হবে নাকি দিন বদলাবে? তবুও লেখাটি শেষ করতে চাই আশাবাদ দিয়েই, সুদিন আসবেই। কবিগুরুর কথায় বলতে হয়, ‘দূর হোক সকল অকল্যাণ, এসো গাহি মঙ্গলের জয়গান’।