রোজার সময় মানুষের দৈনন্দিন কার্যকলাপের পরিবর্তন ঘটে। স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, ওষুধ গ্রহণের সময়সূচি, ঘুমের সময় ও পরিমাণ পরিবর্তিত হয়। একজন সুস্থ স্বাভাবিক পূর্ণবয়স্ক মানুষ যেভাবে এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তা একজন অসুস্থ মানুষ বা হৃদরোগীর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।
প্রায়ই দেখা যায়, হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের অনেকের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যাজমা, কিডনির অক্ষমতা ইত্যাদি পাশাপাশি অবস্থান করে। ফলে রোজার সময় খাদ্যাভ্যাস ও ওষুধপত্র নতুন করে সময়োপযোগী করে নিতে হয়। এসব বিষয়ে কিছু বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
রোজা নয় যেসব হৃদরোগীর
♦ যাঁদের হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা কম (LVEF ২৫ ভাগের নিচে) তাঁদের রোজা না রাখাই ভালো।
♦ যাঁদের বয়স ৭০-এর ওপরে, হার্ট দুর্বল, ডায়াবেটিস আছে, কিডনির সমস্যা আছে তাঁদের রোজা না রাখাই ভালো।
হৃদরোগীর জন্য করণীয়
♦ যেসব হৃদরোগীর হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা স্বাভাবিক তাঁরা অন্য সবার মতো রোজা রাখতে পারবেন।
♦ হৃদরোগীদের বেশিরভাগ ওষুধ দিনে একবার বা দুইবার খেলেই হয়। যেসব ওষুধ দিনে একবার খেলে চলে রোজার সময় সেগুলো রাতের খাবারের সময় নিলেই চলবে।
♦ যেসব ওষুধ দিনে দুইবার খেতে হবে সেগুলো ইফতার ও সাহরির সময় খেলে চলবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন দুই ডোজের মধ্যবর্তী সময়টি সংক্ষিপ্ত না হয়। বিশেষ করে রক্তচাপের ওষুধ পর্যাপ্ত ফারাক দিয়ে সেবন করতে হবে। রোজার সময় খাদ্য ও পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় রক্তচাপ কমে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে মাত্রা কমানো যেতে পারে।
♦ হৃদরোগের কিছু কিছু ওষুধ (যেমন Nitrate) সকালে ও বিকেলে খেতে হয়, রোজায় সেগুলো সাহরি ও ইফতারের সময় সমন্বয় করা যায়। কিছু ওষুধ দিনে তিনবার নিতে হয় (যেমন Diltiazem) সেগুলো স্লো রিলিজ ফর্মে দিনে একবার বা দুইবারে খাওয়া যায়।
♦ হৃদরোগীদের মধ্যে যাঁদের ডায়াবেটিস আছে তাঁদের বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। দিনের দীর্ঘ সময় খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ না করায় রক্তে সুগারের পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেললে বা মাথা ঝিমঝিম করলে, বুক ধড়ফড় করে প্রচুর ঘাম দিলে সুগারের মাত্রা কমে যেতে পারে বলে সন্দেহ করতে হবে এবং তত্ক্ষণাৎ সুগার পরীক্ষা করা সম্ভব হলে করতে হবে।
পরীক্ষা করা সম্ভব না হলে হাতের কাছে চিনি জাতীয় যা কিছু পাওয়া যায় দ্রুত খেয়ে রোজা ভেঙে ফেলতে হবে। পরবর্তী সময় ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে ওষুধের মাত্রা ঠিক করতে হবে।
তবে রোজার সময় যেসব ওষুধ দ্রুত রক্তের সুগার কমায় তা এড়িয়ে চলা উত্তম। ইনসুলিনের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ইনসুলিনের মেজর অংশটি ইফতারের সময় নিলে ভালো, আর স্বল্প মাত্রাটি সাহরির সময় নিতে হবে, যাতে দিনের দীর্ঘ সময়ে সুগার কমে না যায়।
♦ হৃদরোগীদের মধ্যে যাঁদের অ্যাজমা আছে তাঁদের মুখে ওষুধ গ্রহণে তেমন সমস্যা হয় না। সাহরি-ইফতারির সময় নিলেই হবে। তবে যাঁদের ঘন ঘন ইনহেলার (যেমন Azmasol Inhaler বা Nebulizer) নিতে হয় তাঁরা সেটি নিতে পারবেন। কারণ ইনহেলার ফুসফুসে বাতাসের সঙ্গে টেনে নিতে হয়। পেটে যাওয়ার দরকার পড়ে না। আর যেসব ইনহেলার (যেমন Bexitrol Inhaler) দিনে দুইবার নিয়মিত নিতে হয়, সেগুলো সাহরি ও ইফতারির সময় নিলেই চলবে।
খাবারদাবার
♦ তৈলাক্ত, ভাজাপোড়া খাদ্য (যেমন পেঁয়াজু, বেগুনি, কাবাব, পরোটা, হালিম ইত্যাদি) এড়িয়ে চলা উচিত।
♦ নরম খাবার যেমন চিঁড়া ভিজানো, কাঁচা ছোলা বা তেলমুক্ত সিদ্ধ ছোলা, দুটি খেজুর, কলা, দই এসব দিয়ে ইফতার করা যেতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি, লেবুর শরবত, রসালো ফল, ডাবের পানি, কমলার রস ইত্যাদি শরীরের জন্য ভালো।
♦ ইফতার পরিমিত পরিমাণে হতে হবে। হঠাৎ অতিরিক্ত ইফতার করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি বা পানীয় গ্রহণ করতে হবে, যাতে দিনের পানিশূন্যতা পুষিয়ে দেওয়া যায়।
লেখক : সিসিইউ ইনচার্জ, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল