আত্মপরিচয়ের জন্য একটি সাংস্কৃতিক কেবলা অনুসন্ধানের কবি ও ভাবুক এনামূল হক পলাশ এর ৪৮ তম জন্মদিন আজ।
কবি এনামূল হক পলাশ বাংলা ভাষার সহজিয়া ধারার একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি, ভাবুক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, শিশু সাহিত্যিক ও গীতিকার। তিনি বামপন্থী বিপ্লবী রাজনৈতিক ধারার একজন কর্মী ছিলেন। তিনি অন্তরাশ্রম নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন এবং একই নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন পরিচালনা করেন। তাঁর জন্ম ২৬ জুন ১৯৭৭।
শিশুকাল নিজ গ্রামে কাটালেও পিতার ব্যবসাজনিত কারনে তাঁর শৈশব কেটেছে বারহাট্টার গোপালপুর বাজারে। ১৯৮৮ সালে ট্যালেন্টপুল বৃত্তি পেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন।
বারহাট্টা সি.কে.পি. পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু করে অষ্টম শ্রেনীতে সাধারণ বৃত্তি পান এবং ১৯৯৪ সালে বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারমিডিয়েট কলেজে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু করে ১৯৯৬ সালে প্রথম বিভাগে এইচ এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
১৯৯৫ সালে উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী থেকে প্রকাশিত মাটির সুবাস নামক একটি পত্রিকায় তাঁর একটি কবিতা প্রকাশিত হয় যা ছিল ছাপার অক্ষরে তাঁর প্রথম কবিতা। প্রকাশিত কবিতার জন্য তিনি মনি অর্ডার যোগে চল্লিশ টাকা সন্মানী প্রাপ্ত হয়েছিলেন। উক্ত চল্লিশ টাকার খরচ বাদে সাতত্রিশ টাকা পঁচিশ পয়সা হাতে পেয়েছিলেন তিনি।
১৯৯৭ সালে সরকারী তিতুমীর কলেজে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে অনার্স ভর্তি হন। ১৯৯৮ সালে তিনি টিসি নিয়ে নেত্রকোণা সরকারী কলেজে চলে আসেন এবং একই কলেজ থেকে ২০০২ সালে দ্বিতীয় শ্রেনীতে স্মাতক (সম্মান) উত্তীর্ণ হন। তিনি গুরু দয়াল সরকারী কলেজে মাস্টার্স ভর্তি হয়ে ২০০৪ সালে উদ্ভিদ বিদ্যায় দ্বিতীয় শ্রেনীতে মাস্টার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৯৮ সালে একটি প্রগতিশীল বাম সংগঠনের সাথে তাঁর যোগাযোগ স্থাপন হয় এবং তিনি প্রগতিশীল বিপ্লবী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
এ সময় রাজনৈতিক বিষয়ে ব্যপক অনুশীলন ও পড়াশোনা করেন। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন সময় কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার সাথে যুক্ত থেকে সাংবাদিকতা করেছেন।
কবি, লেখক ও সংস্কৃতি কর্মীদের ব্যবহারের জন্য ২০১৭ সালে তিনি নেত্রকোনা শহরের মালনী এলাকায় গড়ে তুলেছেন “অন্তরাশ্রম”নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা ও আচার্য। সেই সাথে তিনি অন্তরাশ্রম নামে একটি সাহিত্যের ছোট কাগজ প্রকাশ করেন।
তিনি ২০১৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে কুপিবাতি নামক একটি ভাষ্কর্য স্থাপন করেন। ২০২১ সালে তিনি নেত্রকোণায় একটি ‘ভূমি জাদুঘর’ (ভূমি ও কৃষি উপকরণ প্রদর্শনশালা) প্রতিষ্ঠার ধারণাপত্র তৈরি করেন এবং পরবর্তীতে তার ধারণার উপর ভিত্তি করে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নেত্রকোণার মেছুয়া বাজার সংলগ্ন পুরাতন সদর কাচারিকে ভূমি জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে অবস্থান নিয়ে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই চালিয়েছেন।
২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন – “ঘর যে তৈরী করেছেন তার মধ্যে এক্সিট পয়েন্ট রেখেছেনতো?” লাইক মাত্র ৭ টা। কমেন্ট ৩ টা। ঘটনাচক্রে এক্সিট পয়েন্টটি বেদনাদায়ক ছিল। সেটা ঘটেছিল ২০২৪ সালে। ২০০৯ সাল থেকেই তিনি ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে সরব ভূমিকা পালন করেছেন। লিখে গেছেন অবিরাম। রচনা করেছেন বইয়ের পর বই। ২০১৮ সালের শিশু বিদ্রোহে তিনি সমর্থন যুগিয়েছেন। ফ্যাসিবাদ আমলে তিনি গণতন্ত্রের গান ও রাত্রির গান নামে দুটি গান রচনা করেন এবং ইউটিউব চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
এরমধ্যে ২০২৪ সালের মার্চ মাসের শেষ দিকে সংবাদ মাধ্যমে মত প্রকাশের অভিযোগে তাকে চাকুরিচ্যুত করার জন্য তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। তিনি তাতেও থেমে থাকেন নি। প্রকাশ্য ও গোপণে আন্দোলনকারীদের প্রতি সমর্থন যুগিয়েছেন। সেই সাথে বৈষম্যবিরোধী কবি ও লেখকদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রেখে নিজ শহরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সংগঠিত করতে মানসিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন।
৩০ জুলাই তিনি নিজের প্রোফাইল পিকচার লাল করায় ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজন তাকে বিভিন্ন হুমকী দেয়। ৩৪ জুলাই থেকে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি নিজ শহরে রাজপথে অবস্থান নেন। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত লেখা কবিতাগুলো নিয়ে ঘাসফুল থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার কবিতাগ্রন্থ “পলায়নের আগে”।
প্রকাশিত কবিতার বই- অস্তিত্বের জন্য যুদ্ধ চাই, জীবন এক মায়াবী ভ্রমণ, অন্ধ সময়ের ডানা, অন্তরাশ্রম, মেঘের সন্ন্যাস, পাপের শহরে, জল ও হিজল, তামাশা বাতাসে পৃথিবী, অখন্ড জীবনের পাঠ, লাবণ্য দাশ এন্ড কোং, সুফি কবিতা, পলায়নের আগে
প্রকাশিত শিশুতোষ কবিতার বই- বইয়ের পাতায় ফুলঝুরি , কলমিলতার ফুল, মগড়া নদীর বাঁকে, পাখ পাখালির ছড়া, পাখ পাখালির কবিতা।
প্রকাশিত গবেষণাধর্মী বই- ভূমি ব্যবস্থাপনার সরল পাঠ
কবিকে নিয়ে স্মারক গ্রন্থ- আশ্রম পাখির মায়াপথ
অনুবাদ গ্রন্থ- ধর্ম বিশ্বাস আখ্যানের মতো সুন্দর (আল মা-আরির কবিতা), মু-আল্লাক্বা (ইমরুল কায়েসের কবিতা), লিখে রাখো আমি একজন আরব (মাহমুদ দারবিশের কবিতা), আরব ভূখন্ডের কবিতা, নদী মরে যায় পিপাসায় (মাহমুদ দারবিশের ডায়েরি), নির্বাচিত কবিতা নাজিম হিকমত, আদিবাসী নারীদের কবিতা
ইংরেজিতে ভাষান্তরিত কবিতার বই – CROSSING FORTY NIGHTS
সম্মাননা- চর্চা শুভেচ্ছা সন্মাননা- ২০১৭, মেঠোসুর গুণিজন সন্মাননা- ২০২৪, কংস থিয়েটার সম্মাননা- ২০২৪
ইতিপূর্বে তিনি রাত্রির গান, গণতন্ত্রের গান, বাউল জন্ম, যে আমারে ভালোবাসে, আগুনের গান, রশিক হাওয়া, নয়া পানির তিতনা পুটি, শুন্য বোতল, সাদাকালো জীবন, প্যাঁচিয়ে থাকা দড়ি, কেমন করে সাধু হবো, একটি তারেই মুনতাহাতে, আমারে বনবাসে রাইখ্যা বন্ধু, ভালো আমি বাসলাম যারে, ঈদের গান, মন আমার মোচড় মারে সহ অনেক জনপ্রিয় গান রচনা করেছেন।
এর মধ্যে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে লিখে প্রচার করেছেন রাত্রির গান, গণতন্ত্রের গান এবং আগুনের গান।
তিনি মনে করেন বাংলাদেশের মানুষের আত্মপরিচয় জানতে একটি সাংস্কৃতিক কেবলা অনুসন্ধান করতে হবে। এই অনুসন্ধানের ভেতর এদেশে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটবে।
সাংস্কৃতিক কেবলা’র ধারণা তিনিই প্রথম বাংলা সাহিত্যে উচ্চারণ করেছেন।