রংপুর প্রতিনিধিঃ দলিল সম্পাদন করতে গেলে সরকারি ফি-এর বাইরে ঘুষ দিতে হবে—না হলে প্রক্রিয়া আটকে যাবে। এমন বাস্তবতায় জিম্মি হয়ে পড়েছে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সাধারণ মানুষ। উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দেদারসে চলছে ঘুষ বাণিজ্য। সর্বশেষ ঘটনায় প্রকাশ্যে এসেছে এক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজসে দেড় লাখ টাকার ঘুষ দাবির অভিযোগ। গত বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট, ২০২৫) সকালে মর্গেজ দলিল করতে তারাগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যান বাজারের ব্যবসায়ী জোবায়ের হাসান অভি। সেখানে নকল নবিস হীরা সাব-রেজিস্ট্রার রিপন চন্দ্র মন্ডলের নাম ব্যবহার করে তার কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। জোবায়ের হাসান অভি বলেন, “সরকারি ফি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।
কিন্তু হঠাৎ করে অতিরিক্ত দেড় লাখ টাকা চাইলো। অস্বীকৃতি জানালে দলিল আটকে রাখার হুমকি দেয়। পরে সাব-রেজিস্ট্রার নিজেই সিরিয়াল থেকে আমার দলিল সরিয়ে রাখেন।” অভি আরও জানান, “সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের নকল নবিস হীরা আমার মুঠোফোনে ফোন দিয়ে বলে কর্মকর্তা রিপন চন্দ্র মন্ডল টাকা ছাড়া দলিল পার করবেন না, টাকা লাগবে দেড় লাখ ।
টাকা ছাড়া এই দলিল কোন ভাবেই পার হবেনা । এরপর আমি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে দেখি আমার দলিল নিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা ও আমার অফিস স্টাফরা বসে আছে । হীরার ইশারায় দলিলে হাত দিচ্ছেনা কর্মকর্তা । বারংবার দাবিকৃত টাকার চাপ দিচ্ছিল । দলিল সরিয়ে রেখে জানায়, এ সপ্তাহে এই দলিলে হাত দেবেনা ।
এরপর তাদের সাথে আমাদের ঘুষ চাওয়া নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়, বাধ্য হয়ে গনমাধ্যমের শরণাপন্ন হই । অভির অভিযোগে দিনভর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সাংবাদিকরা বিষয়টি জানতে চাইলে সাব-রেজিস্ট্রার প্রথমে গড়িমসি করেন। পরে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নবাণে কোণঠাসা হয়ে সন্ধ্যার আগে দলিল সম্পাদন করতে বাধ্য হন সাব-রেজিস্ট্রার রিপন চন্দ্র মন্ডল ।
উপজেলার সাধারণ মানুষের অভিযোগ, এটি একদিনের ঘটনা নয়। বরং বহু বছর ধরে অফিসটিতে একইভাবে চলছে ঘুষের দৌরাত্ম্য। সরকারি ফি প্রদানের পরও বাড়তি টাকা না দিলে দলিল আটকে রাখা হয়। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকেই অতিরিক্ত টাকা গুনে থাকেন। উপজেলার একজন শিল্পপতি বলেন, “একটা সাধারণ দলিল তুলতে বা নকল তুলতে সরকারি ফি’র তিন-চার গুণ বেশি টাকা দিতে হচ্ছে। টিন সার্টিফিকেটের অজুহাতে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের নাজেহাল করছে এরা । মোটা অংকের টাকা না দিলে কোনো কাজ এগোয় না।
এটা পুরোপুরি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি।” জানা গেছে, সাব-রেজিস্ট্রার রিপন মন্ডল রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে বহুবার অভিযোগ উঠলেও রেহাই পেয়ে আসছে । রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডলের ভাগনে পরিচয়ে প্রভাব খাটিয়ে সে নিয়মিত অনিময়-দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে । ৫ আগষ্টের পরে তার নামে ছাত্র হত্যার মামলাও হয়েছে । গঙ্গাচড়া ও বীরগঞ্জ উপজেলায় দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে দুদকের অভিযান, মানববন্ধন, এমনকি অবরোধ কর্মসূচি হলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দেড় লক্ষ টাকা ঘুষ কেলেঙ্কারি নিয়ে সাব-রেজিস্ট্রার রিপন মন্ডল, হীরা, জেলা সাব রেজিস্ট্রার সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তারা মুখে কুলুপ এঁটে বসেছে ।
বক্তব্য দিতে আগ্রহী নয় কিন্তু খবর প্রকাশ না করতে বিভিন্ন মাধ্যমে তদবিরে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বেপরোয়া ঘুষ দুর্নীতিতে জিম্মি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে নাগরিক সেবা ব্যাহত হচ্ছে কি না জানতে চাইলে ইউএনও রুবেল রানা জানান, “দুর্নীতি যে কোনো সমাজের জন্য একটি বিষাক্ত ক্যান্সারের মতো, যা নাগরিক সেবার মূল ভিত্তিকে দুর্বল করে তোলে। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যদি বেপরোয়া ঘুষ এবং দুর্নীতির ছায়া পড়ে থাকে, তাহলে তা নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষের অধিকার এবং সেবা প্রাপ্তির পথে একটি অদৃশ্য বাধা সৃষ্টি করে।
আমরা এই ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি অনুসরণ করছি। প্রশাসনিক স্তরে কঠোর নজরদারি, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে আমরা এই সমস্যা মোকাবিলা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নাগরিকদের কাছে আমার আহ্বান, যেকোনো অনিয়মের খবর দিন—আমরা একসঙ্গে একটি দুর্নীতিমুক্ত, সেবামুখী প্রশাসন গড়ে তুলব। এটি শুধু দায়িত্ব নয়, আমাদের নৈতিক কর্তব্যও।