রুহুল আমিন, ডিমলা(নীলফামারী)
প্রায় পানিশুন্য তিস্তা নদীর জেগে ওঠা চরগুলোতে ব্যাপক হারে বিভিন্ন জাতের ফসল উৎপাদন হচ্ছে।
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় এসব চরের বেলে-দোআঁশ মাটিতে স্বল্প খরচে ২৫ ধরনের ফসল উৎপাদন করছে কৃষকরা। এছাড়া চলতি মৌসুমে চরাঞ্চলে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বেড়েছে ১ হাজার হেক্টর।
এবার চরগুলোতে ৪০ কোটি টাকার ফসল পাওয়া যাবে বলে ধারনা স্থানীয় কৃষি বিভাগের।
তবে চরাঞ্চলের জমি নদী ভাঙনের ঝুঁকি থেকে
রক্ষা করতে না পারলে উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
এ ছাড়া ফসল উৎপাদনের জন্য সৌরসেচ ব্যবস্থা, রক্ষার জন্য গুদাম নির্মাণ ও পরিকল্পিত নদী শাসনের দাবি জানিয়েছেন কৃষকরা।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, তিস্তা নদীবেষ্টিত এ উপজেলার ৬টি (ঝুনাগাছ চাপানী, খালিশা চাপানি, গয়াবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খগাখড়িবাড়ি, পশ্চিম ও পূর্ব ছাতনাই) ইউনিয়নের মোট চরের সংখ্যা ১৬টি। যার সবই আবাদযোগ্য।চলতি মৌসুমে এসব চরে প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে ফসল উৎপাদন হচ্ছে। যা গতবারের চেয়ে ১ হাজার হেক্টর বেশি।
বিভিন্ন চরাঞ্চলে ঘুরে দেখা গেছে , এসব চরে চাষ করা হয়েছে, ভুট্টা, আলু, ধান, কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ,রসুন,মিষ্টি কুমড়া ও লালশাকসহ নানা ধরনের রবিশস্য।পাশাপাশি প্রস্তুতি চলছে গম, ছোলা, মসুর, সরিষা ও বাদাম চাষের।
চরের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারা বছরই চরের জমিতে ২০ থেকে ২৫ ধরনের ফসল চাষ করা হয়। বন্যার পর চরের মাটিতে পলি জমে। এ কারণে সার খুব একটা লাগে না।পোকামাকড়েরও আক্রমণ কম। কীটনাশকের ব্যয় তেমন নেই। তাই ফসল উৎপাদনে খরচও কম। কিন্তু, যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকার কারণে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় না তারা।
দোহলপাড়া চরের কৃষক ফরিদ ইসলাম বলেন, চরের জমিতে বিশেষ করে ভুট্টা, আলু, বাদাম এবং পেয়াজ চাষ করে বিপ্লব ঘটেছে। চরের প্রতি শতক জমিতে প্রায় দুই মণ করে ভুট্টা উৎপাদন হয়। এতে উৎপাদন খরচের চেয়ে লাভ হয় তিনগুন। পরিকল্পিত নদী শাসন এবং খননের মাধ্যমে চরের জমিকে সব সময় বসবাস এবং কৃষিকাজের উপযোগী রাখা সম্ভব বলেন তিনি।
কৃষক আব্দুল লতিফ (৬০) পাঁচ একর জমিতে ভুট্টা, পেঁয়াজ, আলু, মরিচ ও শাকসবজি চাষ করেছেন।
লতিফ বলেন, বালুচরে যে এত প্রকার আবাদ হচ্ছে তা আমাদের ভাগ্য। বন্যায় চরান্ঞ্চলের মানুষের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, তার কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারছে এমন আবাদে।
ছাতুনামা চরের আলিমা বেগম বলেন, নিজের ঘর , আবাদি জমিও সোউগ আছিল তার। নদীর বান আইসা জমির সাথে ঘরটাও নিয়া গ্যাছে (নদীগর্ভে বিলীন)। তহন থাইকাই বান্দের ওপর থাহি। সারা দিন চরে কাম করি। চরোত যদি ফসল না অইতো হয়, আমগো যে কী দশা, কি খাইতাম তা আল্লায় জানে।
তবে ফসল ঘরে তোলা আর বিক্রি নিয়ে আছে চরের কৃষকদের নানা আভিযোগ।
চর কিসামতের কৃষক আরিফ হোসেন বলেন,
সব কৃষিপণ্য চরের জমিতে উৎপাদন হয় । কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় কৃষকেরা উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বিশাল চর আর নদী পাড়ি দিয়ে ফসল নিয়ে যেতে হয় হাটে। ফলে উৎপাদন বেশি হলেও ব্যয়ও বৃদ্ধি পায় বহনে। হাট থেকে এক বস্তা সার কিনে চরে পৌছাতে অতিরিক্ত খরচ হয় ১০০ টাকা। আবার চরের ফসল ডাঙ্গায় নিতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় তাদের।
হযরত আলী নামের কৃষক বলেন, বাজারে যদি সবজির কেজি ১০০ টাকা হয়, তাহলে চরে ৫০ টাকা। পরিবহন ব্যায়ের কারনে চরের এপার-ওপারে দামের এই পার্থক্য। চরের ফসল বাজারজাত করতে পাড়ি দিতে হয় বিস্তীর্ণ বালুচর। চরের মাঝে তিন থেকে চারটি ছোট নদী থাকে। তখন ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়। এমন ভোগান্তির কারণে চরে ভালো ফসল উৎপাদন হলেও আমরা ভালো দাম পাই না।
এঅবস্থায় কৃষকরা সরকারের কাছে চরাঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য সংরক্ষণ, বিপনন ও নদী খনন করে তিস্তা মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি জানান।
তিস্তাপারের সাধারণ মানুষ মনে করে, তিস্তায় সারাবছরই ভাঙন থাকে। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নদীর ভাঙন বন্ধ হবে, কম পানিতে বন্যা দূর হবে ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হবে।
কৃষিবিদ আবু সায়েম বলেন, চরে কৃষকরা যেভাবে ফসল ফলাচ্ছেন তা বিস্ময় ও বড় সাফল্য। কৃষি বিভাগের উচিত এসব চর এবং চরের আবাদ নিয়ে একটা পরিকল্পনা করা, যাতে ফসলগুলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সহজে ও স্বল্প খরচে পাঠানো যায়।
পাশাপাশি চরে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সেকেন্দার আলী বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত বীজের ছোঁয়ায় বদলে গেছে তিস্তা চরের কৃষি চিত্র। চরের পতিত জমিতে যে ভুট্টা উৎপাদন হচ্ছে, তা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অন্ঞ্চলে রফতানি হচ্ছে।এছাড়া চরে আলু, পেঁয়াজসহ প্রায় সব ধরনের মশলাজাতীয় পণ্য ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে।
সেকেন্দার আলী জানান, প্রতি বছর তিস্তার উজানের ঢলে ফসলি জমিতে পানি প্রবেশ করে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয় । তাই এলাকার চাষীদের সরকারি কৃষকদের প্রণোদনার আওতায় আনা হচ্ছে।নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ার পর, যে সব চর পানিতে কিছুদিন ডুবে থাকে, সেখানে পানি সহনীয় জাতের ধান চাষে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
বর্তমানে চরে আবাদযোগ্য জমি বৃদ্ধি পেয়েছে।
পরিকল্পিত নদী শাসন করে চরের জমি আরো বৃদ্ধি করা সম্ভব বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।