বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১১, ২০২৪

বিচার না চাওয়ার সংস্কৃতি: নিরীহ সন্তান হত্যার বিচার চায় না কেন পরিবার?

যা যা মিস করেছেন

ঘটনা-১ঃ গত ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদ এলাকায় দুর্বৃত্তের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু। ওই সময় টিপুর গাড়ির পাশেই যানজটের কারণে সড়কে আটকা পড়েছিল বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফরিন প্রীতি (১৯) এবং তার বান্ধবী সুমাইয়াদের বহনকারী রিকশা। গুলি এসে লাগে রিকশায় বসে থাকা প্রীতির শরীরেও। টিপুর গাড়িচালক মনির হোসেন মুন্নাও গুলিতে আহত হন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাদের হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, মেয়েকে হারিয়ে প্রীতিদের শান্তিবাগের বাসায় শোকের মাতম চলছিল। শোকার্ত মা হোসনে আরা শুধু বলছিলেন, “বিচার চাই না। শুধু মেয়ের লাশ পৌঁছে দিলেই হবে।” আর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে প্রীতির বাবা জামাল উদ্দিন বলেছিলেন, “একজনকে মারতে গিয়ে আমার মেয়ের শরীরে গুলি লেগেছে।
সন্তানের এমন মৃত্যু কোনো বাবা-মা চান না। আমি তো মেয়ে হারিয়েছি। সম্পদ গেলে সম্পদ ফিরে পাওয়া যায়, কিন্তু কোনো প্রাণ গেলে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না। আমি কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাই না… মেয়ে হত্যার বিচার চাই না। মামলা চালানোর মতো অবস্থাও নেই। আমরা নিরীহ মানুষ। বিচার চাইলে আল্লাহর কাছে চাই।” এমনকি মেয়ে হত্যার শাস্তি চাইতে গিয়ে ‘বিবাদে’ও জড়াতে চান না বলে জানান তিনি, “কার শাস্তি চাইব? আমি তো কাউকে চিনি না, জানি না কে আমার মেয়েকে মেরেছে। কোনো বিবাদে জড়াতে চাই না।”

ঘটনা-২ঃ গত ০১ এপ্রিল রাতে খিলগাঁও তিলপাপাড়া এলাকায় স্বামীর সাথে মোটরসাইকেলে করে বাসায় ফিরছিলেন ২০ বছর বয়সী গৃহবধূ নাসরিন খানম। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি তাদের মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দিলে নাসরিন পড়ে যান এবং তার মৃত্যু হয়।

পরদিন চ্যানেল আইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়ঃ নিহত নাসরিনের পরিবারের পক্ষ থেকে জিডি করা হলেও কোন মামলা করা হয়নি। ঘটনার পর গাড়িচালক বকুল মিয়াকে আটক করা হলেও নিহতের পরিবার থেকে কোন মামলা না করায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে জানায় খিলগাঁও থানা পুলিশ। নাসরিনের স্বামী মোঃ শামীম জানান, বিচার পাবেন না বলে তারা বিচার চান না। শামীম বলেন, “দেশের ভেতর কতো কী ঘটছে! কেউ পেরেছে? কোনকিছুই হয় নাই। আপনারা সংবাদ (প্রচার) করবেন, জনগণকে জানাবেন। পুলিশ কিছুই করবে না। দেশ দেশ নিয়েই থাকবে। এই আইন আমাদেরকে শেখাবেন না।”

ঘটনা-৩ঃ গত ১৯ এপ্রিল সকালে কামরাঙ্গীরচরের বাসা থেকে বের হয়ে নিউমার্কেট হয়ে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন নাহিদ হোসেন (২০)। কিন্তু, নুরজাহান মার্কেটের সামনে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও দোকান কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুরুতর আহত হন তিনি। এরপর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে ওইদিন রাতেই তার মৃত্যু হয়।

নিজ পরিবারকে নিয়ে কামরাঙ্গীরচরে বসবাস করতেন এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের একটি কম্পিউটার সরঞ্জামের দোকানে ডেলিভারিম্যান হিসেবে কর্মরত নাহিদ।
নিহত নাহিদের রোজগার দিয়েই চলতো ছয়জনের পরিবারটি।

তার ছেলে বিবাদমান কোন পক্ষের লোক ছিলেন না জানিয়ে নাহিদের বাবা বলেন, “আমরা নিরীহ মানুষ। কারও সঙ্গে ঝামেলার মধ্যে নেই। কে মারল, কেন মারল আমার ছেলেকে। ওর তো কোনো অপরাধ নেই। কারও কাছে বিচার চাই না। বিচার চেয়ে কী হবে? কার কাছে বিচার চাইবো? মামলাও করতে চাই না। এটাই তো কপালে লেখা ছিল… শুনেছি অনেকে মিলে ওকে বেদম পিটিয়েছে। ওতো কোনো পক্ষের লোক না। নিউমার্কেটের হকারও না, কলেজের ছাত্রও না।” বিচার চাইলেও বিচার পাবেন না মন্তব্য করে ছেলেহারা শোকাহত মা নার্গিস বলেন, “আমরা বিচার চাই না। নাহিদকেতো ফেরত পাবো না। বিচার চেয়ে কী হবে? বিচার চাইলেই তো আর বিচার পাব না। আমার ঘর-সংসার কীভাবে চলবে?”

উপরের তিনটি ঘটনার দিকে নজর দিলে দেখা যাবে প্রত্যেকটি ঘটনার ক্ষেত্রেই দুটি মিল রয়েছে। প্রথমতঃ নিহত নাসরিন, প্রীতি এবং নাহিদ প্রত্যেকেই নিরীহ ছিলেন। যেসব ঘটনায় তাদের মৃত্যু হয়েছে সেসবের সাথে তাদের দূরতমও কোন সম্পর্ক ছিল না। তারা নিতান্তই ভুক্তভোগী। দ্বিতীয়তঃ নাসরিন, প্রীতি এবং নাহিদ প্রত্যেকেই নিজ নিজ পরিবারে ছিলেন আদরের সন্তান। কিন্তু নিহত প্রিয়জন নিরীহ ছিলেন জেনেও তাদের পরিবার তাদের হত্যার কোন বিচার চাইছেন না!

খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, যারা তাদের নিরীহ প্রিয়জনকে হত্যার বিচার চান না, তাদের মনে কি তবে এমন ধারণা জন্মেছে যে, বিচার চেয়ে কোন লাভ নেই? কিংবা বিচার হলেও সেটা ‘ন্যায়বিচার’ হবে না? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই এমন প্রশ্ন রাখছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান ফেসবুকে লিখেছেন, “বিচার না পাওয়ার চেয়েও বিচার না চাওয়ার সংস্কৃতি অধিক আশংকাজনক!”

প্রীতি হত্যার পর বিবিসির সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান ২৬ মার্চ লিখেছিলেন, “ঢাকার রাস্তায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুজন নিহত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও দেশের একজন নাগরিক হিসেবে এতে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। এরকম হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর সব শহরে প্রতিদিনই হচ্ছে। কিন্তু আমি উদ্বিগ্ন অন্য একটি কারণে। হত্যাকাণ্ডের পর নিহত মেয়েটির মা বলেছেন তিনি লাশ ফেরত চান, বিচার চান না। পিতা বলেছেন আমি বিচার চাই না, কার কাছে চাইবো। বুঝতে পারছেন গত ৫০ বছরে আমরা কেমন রাষ্ট্র তৈরি করেছি! সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।”

আমিনুল ইসলাম নামের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছিলেন, “একজন পিতার নিরপরাধ মেয়েকে খুন করা হয়েছে। অসহায় পিতা দুনিয়াতে বিচার না চেয়ে আখেরাতে বিচার চাচ্ছেন। এ যেনো এক নীরব প্রতিবাদ।”

বিঃদ্রঃ এই প্রতিবেদনটি যখন লেখা হচ্ছিল তখনই খবর প্রকাশিত হয় যে, নিউ মার্কেটে ব্যবসায়ী এবং ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় মুরসালিন নামে আরও একজন দোকান কর্মচারীর মৃত্যু হয়েছে।

অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।

প্রিয় পাঠক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্যামেইলবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন themailbdjobs@gmail.com ঠিকানায়।

More articles

সর্বশেষ

x  Powerful Protection for WordPress, from Shield Security
This Site Is Protected By
Shield Security