শনিবার, এপ্রিল ১৩, ২০২৪

ভক্তদের চুল বিক্রি করে বছরে ২০০ কোটি টাকা আয় করে যে মন্দির

যা যা মিস করেছেন

বেঙ্কটেশ্বর একাই নয়, দক্ষিণ ভারতের আরও কিছু মন্দির একই ব্যবসা করে। সব মিলিয়ে ভারতের মন্দিরগুলো বছরে চুল বিক্রি থেকে ১০০ মিলিয়নের বেশি টাকা সংগ্রহ করে। থিরুথানি মুরুগান মন্দিরে মাথা মোড়াচ্ছেন এক নারী।

ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুমালায় অবস্থিত বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরকে সংগৃহীত দান ও আয়ের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মন্দির বলা হয়ে থাকে। তবে অবাক করার মতো বিষয় হলো মন্দিরের বার্ষিক আয়ের দশ ভাগের এক ভাগই আসে ভক্তদের দান করা চুল থেকে।

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বুক অনুসারে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষের সমাগম ঘটে এই মন্দিরে। প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত মন্দিরটিতে দৈনিক প্রায় ৭৫ হাজার ভক্তের আগমন ঘটে। বিষ্ণুর অবতার দেবতা বেঙ্কটেশ্বরের কাছে মানত নিয়ে আসেন এই ভক্তরা। তবে ভক্তদের এই শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসকে পুঁজি করেই চলছে নকল চুলের কয়েকশ কোটি টাকার বাণিজ্য। হলিউডের নামিদামী তারকারা এখানকার চুলের নিয়মিত গ্রাহক। বস্তুবাদী দুনিয়ার চাকচিক্য, ফ্যাশন আর ট্রেন্ডের যোগান দিয়ে চলেছে আধ্যাত্মিক প্রশান্তির আশায় অর্পিত পুণ্যার্থীদের চুল।

চুলের ব্যবসা

পরচুলা এবং হেয়ার এক্সটেনশনের জনপ্রিয়তা সেলেব্রিটি থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যেও কম নয়। অধিকাংশ পরচুলা ও হেয়ার এক্সটেনশনই আসে চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে।ভারত, চীন ও পূর্ব ইউরোপে গরিব নারীদের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে এজেন্টরা সামান্য অর্থের বিনিময়ে চুল কিনেন। কখনো কখনো স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের মাথার চুল বিক্রি করতে বাধ্য করে। আবার কখনো ছোট বাচ্চাদের খেলনার লোভ দেখিয়ে তাদের মাথা কামিয়ে নেওয়া হয় চুল।

ভারত থেকে চুল সংগ্রহের অন্যতম কারণ হলো এখানকার মানুষের চুল জন্মগতভাবেই মসৃণ ও ঝলমলে। এছাড়া গরীব নারী যারা চুল দান করেন, তারা কখনোই চুলে রঙ করান না। আবার অধিকাংশ নারীই লম্বা চুল রাখতে ভালোবাসেন।

কিন্তু দক্ষিণ ভারতের মন্দিরগুলো পুণ্যার্থীদের অনুমতি ছাড়াই তাদের চুল নিয়ে করছে লাখ লাখ টাকার ব্যবসা। যারা এসব চুল দান করছেন তাদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবার থেকে আসেন। অর্থ কিংবা স্বামী-সন্তানের মঙ্গল কামনায় ঈশ্বরের সামনে চুল বিসর্জন দিয়ে তারা এক ধরনের ত্যাগ স্বীকার করেন। এই নারীরা তাদের চুলের মূল্য জানেন না। জানেন না, কীভাবে তাদের বিশ্বাসকে পুঁজি করে চলছে শত কোটি টাকার ব্যবসা।

পৌরাণিক কাহিনি কেন্দ্রিক বিশ্বাস

তিরুপতি বালাজি বা বেঙ্কটেশ্বরকে বলা হয় ভগবান বিষ্ণুর অবতার। পুরাণে আছে, বেঙ্কটেশ্বর একবার মাথায় আঘাত পান এবং তার মাথার একটি অংশে টাক পড়ে। স্বর্গের এক অপ্সরা বিষয়টি লক্ষ্য করে সাথে সাথে নিজের চুলের একটি অংশ কেটে ফেলেন। সেই কাটা অংশ তিনি মন্ত্রবলে দেবতার মাথায় যুক্ত করে দেন। বেঙ্কটেশ্বর এতটাই খুশি হন যে তিনি তার মন্দিরে আসা ভক্তদের চুল অর্পণ করার নির্দেশ দেন, যেন প্রতিদান হিসেবে সেই চুল তিনি অপ্সরার কাছে পৌঁছে দিতে পারেন।

এই কাহিনির আরেকটি সংস্করণ আছে। শোনা যায় ভগবান বিষ্ণু তার বিয়ের জন্য কুবেরের থেকে ঋণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি সেই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হন। আর তাই এখন পর্যন্ত ভক্তরা তাকে সাহায্য করতে নিজেদের চুল বিসর্জন দেন।

রীতি অনুযায়ী মন্দিরে গিয়ে দেবতার কাছে নিজের চুল সমর্পণ করে অনুগ্রহ চাইতে হয়। মনস্কামনা পূর্ণ হলে ধন্যবাদ জানাতে দ্বিতীয়বার মন্দিরে এসে পুনরায় অর্পণ করতে হবে চুল। তবে মাথা মোড়ানোকে হিন্দু পুণ্যার্থীরা পাপমোচনের অংশও মনে করেন। মাথা মোড়ানোকে অসারতা পরিত্যাগের চিহ্ন হিসেবেও দেখা হয়। অনেকে মনে করেন মাথা মুড়িয়ে অহংকার বিসর্জনের মাধ্যমে তারা ঈশ্বরের সামনে উপস্থিত হতে পারছেন।

বেঙ্কটেশ্বর মন্দির ভারতের সবচেয়ে জনসমাগমপূর্ণ মন্দিরগুলোর একটি। মন্দিরে দৈনিক আগত ৫০ হাজার থেকে এক লাখ ভক্তের মধ্যে ১০-২০ হাজার ভক্তই মাথা মোড়ান অথবা চুল বিসর্জন দেন। হিসাব অনুযায়ী তিরুপতির পুণ্যার্থীদের ৪০ শতাংশই মাথা কামিয়ে থাকেন।

আগে নদীতে চুল ফেলে দেওয়া হলেও বর্তমানে বিক্রির জন্য সারাবছরই চুল সংগ্রহ করে মন্দির কর্তৃপক্ষ।

বিশেষ দিনগুলোতে মন্দিরে পুণ্যার্থীর সংখ্যা বেড়ে যায়। মন্দিরটিতে এক হাজার ৩২০ জন নাপিত সারাবছর কাজ করেন। প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার মানুষের মাথা মোড়ানো হয়। ধারণা করা হয় মন্দিরে প্রতি ১০ মিনিটে একজন পুণ্যার্থী মাথা মুড়িয়ে থাকেন। তবে এখানকার নাপিতরা ভক্তদের থেকে আলাদাভাবে কোনো অর্থ পান না। ২০১৭ সালে ধর্মপ্রাণ আগতদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগে প্রায় ১০০ নাপিতকে কর্মচ্যুত করা হয়।

হাঁটু পর্যন্ত চুলের স্তূপ

২০০৬ সাল থেকে নারী পুণ্যার্থীদের মাথা মোড়ানোর জন্য নারী নাপিতের ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে মন্দিরে ২৭৪ জন নারী নাপিত কাজ করে। তবে ঋতুস্রাব চলাকালে তাদের মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি নেই।

প্রতি ছয় ঘণ্টা পরপর চুলভর্তি ঝুড়ি নিয়ে একটি বড় গুদামে রেখে আসা হয়। সেখানে তৈরি হয় হাঁটু পর্যন্ত চুলের স্তুপ।

এখানে চুলগুলোর জট ছাড়ানোর পর চুলের দৈর্ঘ্য, রঙ ও মান অনুসারে সেগুলো আলাদা করা হয়। এরপর সেগুলো ধুয়ে, পরিষ্কার করে সূর্যের নিচে শুকাতে দেওয়া হয়।

৩১ ইঞ্চির বেশি লম্বা চুলগুলোকে গ্রেড-১ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অন্যদিকে, ১৫ ইঞ্চির বড় ও ৩০ ইঞ্চির ছোট চুলগুলো গ্রেড-২ মানের। ১৫ ইঞ্চির ছোট চুল গ্রেড-৩ হিসেবে নিলামে তোলা হয়। বিভিন্ন গ্রেডের চুলের জন্য বিভিন্ন দাম ধরা হয়।

তবে ১৮ ইঞ্চির বেশি লম্বা চুলগুলোই সবচেয়ে বেশি দামী। এই চুলগুলো প্রতিকেজি ৩০০ থেকে ৪৫০ ডলার মূল্যে বিক্রি করা হয়ে থাকে। খুব ভালো ও চমৎকার মানের চুলগুলো কখনো কখনো প্রতিকেজি ৮০০ ডলারেও বিক্রি হয়ে থাকে। ছোট চুলগুলোও কিন্তু ফেলনা নয়। সেগুলো কখনো ম্যাট্রেসে, আবার কখনো তেলের ফিল্টার তৈরিতে বা কখনো অ্যামিনো এসিডের জন্যও ব্যবহৃত হয়।

বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১১ সালে মন্দির কর্তৃপক্ষ অনলাইন নিলামের আয়োজন করে। শুধুমাত্র ২০১১-১২ সালেই তিরুমালা মন্দির নিলামে চুল বিক্রি করে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আয় করে।

২০১৯ সালে এক অনলাইন নিলামে মন্দির কর্তৃপক্ষ ১৫৭ টন চুল বিক্রি করে, যা থেকে আয়ের পরিমাণ ১৬ লাখ ডলারেরও বেশি।

হলিউড তারকারাই বড় গ্রাহক

ভারতের চুলের একটি বড় অংশ কিনে নেয় ইতালির হেয়ার এক্সটেনশন করপোরেট প্রতিষ্ঠান গ্রেট লেনথ ইন্টারন্যাশনাল।

গ্রেট লেনথ বিশ্বের ৬০টি ভিন্ন দেশে ৪০ হাজারের বেশি সেলুনে নকল চুল সরবরাহ করে থাকে। সেন্ট্রাল লন্ডনের নামিদামী কোনো সেলুনে গ্রেট লেনথের মাথাভর্তি নকল চুল নিতে প্রায় ৯০০ থেকে ১১০০ ডলার খরচ পড়বে। এই চুলের মেয়াদ থাকে ছয় মাস। জেনিফার লোপেজ, প্যারিস হিলটন, বিয়ন্সে এবং টায়রা ব্যাংকসের মতো খ্যাতনামা হলিউড তারকারাও গ্রেট লেনথ এক্সেটেনশনের নিয়মিত গ্রাহক।

পুরো বাণিজ্যের বিষয়টি নৈতিকভাবে অসমর্থনযোগ্য হলেও মন্দির কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে ইতিবাচক ভাবেই দেখছে। তাদের বক্তব্য, চুল বিক্রি থেকে আসা টাকা সরাসরি স্থানীয়দের চিকিৎসা সেবা, শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের কাজে ব্যয় করা হয়।

ভারতের চুলের একটি বড় অংশ কিনে নেয় ইতালির হেয়ার এক্সটেনশন করপোরেট প্রতিষ্ঠান গ্রেট লেনথ ইন্টারন্যাশনাল। গ্রেট লেন্থ এক্সটেনশনের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া ছবি।

তবে শুধু বেঙ্কটেশ্বরেই নয়, দক্ষিণ ভারতের বেশ কিছু মন্দিরে একই ধরনের ব্যবসা চলে। সব মিলিয়ে ভারতের মন্দিরগুলো বছরে চুল বিক্রি থেকে ১০০ মিলিয়নের বেশি টাকা সংগ্রহ করে।

শুধু পরচুলাই নয় অ্যামিনো এসিডের কারখানাতেও ব্যবহৃত হয়ে এই চুল। ভারতীয় রাজনীতিক এবং ক্ষমতাসীন দল বিজেপি নেতা নিতিন গাধকারি এর আগে বলেন, তিরুপতি মন্দিরের চুল থেকে তৈরি অ্যামিনো এসিডের সার তার বাগানে এত ভালো কাজ করেছে যে তিনি আরও বড় পরিসরে এ ধরনের সার উৎপাদনের জন্য কারখানা স্থাপন করেছেন।

পুণ্যার্থীদের ইচ্ছা পূর্ণ হোক বা না হোক, মন্দিরে সমর্পিত চুল থেকে যে বহু মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন তা নিয়ে সন্দেহ নাই।

অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।

প্রিয় পাঠক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্যামেইলবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন themailbdjobs@gmail.com ঠিকানায়।

More articles

সর্বশেষ

x  Powerful Protection for WordPress, from Shield Security
This Site Is Protected By
Shield Security