গত ১৫ আগস্ট কাবুল দখলের মাধ্যমে দীর্ঘ ২০ বছর পর আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তালেবান। এরপর পেরিয়ে গেছে ১০ দিন। তবে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠনের ঘোষণা দিতে পারেনি বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ৩১ আগস্টের পর নতুন সরকারের আসবে। তবে তার আগে নতুন উদ্বেগে পড়েছে তালেবান।
এ কথা সবারই জানা যে, আফগানিস্তান বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত একটি দেশ। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যাই পশতুন। যদিও বিনা বাধায় দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবান, তবে এখন সেখানে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ পানশিরের তাজিক জনগোষ্ঠী। তাজিকদের স্বাধীনচেতা মনোভাব তালেবান শিবিরের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পরাশক্তিগুলো যখন তালেবানের কাছে মাথানত করেছে, সেখানে কীভাবে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে তাজিকরা? দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে তাজিকদের। মূলত জাতিগতভাবে তারা যোদ্ধা মনোভাবের। সমরবিদ্যাই তাদের প্রধান শক্তি।
দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে তাজিকদের। ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (এনআরএফ) নেতা আহমেদ মাসুদের বাবা সাবেক গেরিলা কমান্ডার আহমেদ শাহ মাসুদ, যিনি শুধু এই পানশির উপত্যকা নয়, পুরো আফগানিস্তানেই পরিচিত। উপত্যকায় তো বটেই, যার ম্যুরাল দেখা যায় আফগানিস্তানের অন্য এলাকায়ও। সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই যাকে লায়ন অব পানশির নামে পরিচিতি দিয়েছে। সে সময় হাজার হাজার সেনা পাঠিয়ে, হেলিকপ্টার ও ট্যাংকযোগে হামলা চালিয়েও তাকে পরাজিত করতে পারেনি সোভিয়েত ইউনিয়ন। যদিও দুইপক্ষের মধ্যে বেশ কয়েকটি তীব্র লড়াই হয়। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত সেনারা তীব্র প্রতিরোধের মুখে ঢুকতে ব্যর্থ হয় পানশির উপত্যকায়। এ লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেন আহমেদ শাহ মাসুদ। পরে তালেবানদের উত্থানের সময়ও দখলদারমুক্ত থাকে এ উপত্যকা। মাসুদের বাহিনীকে মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে তালেবানদের সহযোগী সংগঠন আল-কায়েদা নাইন-ইলেভেন ঘটনার দুদিন আগে তাকে হত্যা করে। এজন্য হত্যাকারীরা ডকুমেন্টারি নির্মাতার ছদ্মবেশ নেয়। সাক্ষাত্কার নেওয়ার সময় ক্যামেরা ও ব্যাটারির মধ্যে গোপনে রাখা বিস্ফোরকে তার মৃত্যু হয়।
তালেবানরা চেষ্টা যে করেনি তা নয়। উপত্যকার চারপাশ ঘিরে হাজার হাজার যোদ্ধা পাঠিয়েছে তারা। আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে উপত্যকাকে অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
তালেবান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ দাবি করেছেন, তালেবানবিরোধী এনআরএফ’র ঘাঁটি পানশির তারা ঘিরে ফেলেছেন। উপত্যকার প্রবেশমুখে বিপুলসংখ্যক সশস্ত্র যোদ্ধা জড়ো করেছে তালেবান। তারা খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এতে মানবিক সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
যদিও এর আগে তালেবান মুখপাত্র জানিয়েছিলেন, তারা শান্তিপূর্ণ সমাধানেই বেশি আগ্রহী। আলোচনায় আগ্রহ দেখিয়েছে এনআরএফও।
রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাত্কারে দলটির শীর্ষ নেতা আহমেদ মাসুদ আলোচনায় সংকটের সমাধানের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তবে আলোচনা ব্যর্থ হলে পানশিরের ভাগ্য লড়াই ছাড়াই কারো হাতে তুলে দেওয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ে লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন ৩২ বছর বয়সী আহমেদ মাসুদ। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী থেকে নিয়েছেন সামরিক প্রশিক্ষণ। প্রয়াত বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ২০১৯ সালে নামেন রাজনীতির মাঠে।
আলোচনা অথবা লড়াইয়ের হুঁশিয়ারি— কোন পথে সমাধান, সেটা হয়তো জানা যাবে অদূরভবিষ্যতে। বাস্তবতা হলো দোর্দণ্ডপ্রতাপ সত্ত্বেও এখনও পানশির পদানত করতে পারেনি তালেবান। এনআরএফ’র এ প্রতিরোধ যেমন কৃতিত্বপূর্ণ তেমনি আফগানিস্তানজুড়েই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা তালেবানদের কীর্তির ক্যানভাসে সন্দেহাতীতভাবে কালির ছিটা।
পানশিরের এই প্রতিরোধ নেতৃত্বে আছেন দুই তাজিক নেতা। আফগানিস্তানের পতনের পর তালেবানবিরোধী সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা এ উপত্যকার মিলিশিয়াদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তারা তাদের ব্যবহৃত অস্ত্র, যন্ত্রপাতি, যানবাহন ও গোলাবারুদ নিয়ে গড়ে তুলেছেন এনআরএফ। বর্তমানে যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাজিক নেতা লায়ন অব পানশির হিসেবে খ্যাত প্রয়াত কমান্ডার আহমেদ শাহ মাসুদের ৩২ বছর বয়সী ছেলে আহমেদ মাসুদ। এখন পর্যন্ত তালেবান প্রতিরোধের কৃতিত্ব দেখিয়ে চলেছে তার বাহিনী।
অন্য তাজিক নেতা আফগানিস্তানের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহর অবস্থানও এখন পানশিরে। আশরাফ গনির পলায়নের পর তিনি নিজেকে আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে তালেবান প্রতিরোধের ডাক দেন। তিনি দেশেই আছেন দাবি করে বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতি, পালিয়ে যাওয়া, পদত্যাগ বা মৃত্যু হলে ভাইস প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করবেন।
ঐক্য গড়ে তোলার ডাক দিয়ে তিনি টুইটারে লেখেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটো বাহিনীর মতো পালিয়ে যাবে না আফগানরা। তিনি উপত্যকার সিংহ বলে পরিচিত তালেবানবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতীক আহমেদ শাহ মাসুদের আত্মার সঙ্গে বেইমানি না করার অঙ্গীকার করেন।
প্রথম তালেবান সরকারের পতনের পর আফগানিস্তানের রাজনীতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে আফগান গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় ২০১৯ সালে কাবুলে তার অফিসে চালানো আত্মঘাতী হামলাসহ বেশ কয়েকবার হামলা থেকে বেঁচে যান। কাবুলের হামলায় ২০ জন নিহত হয়।
আফগানিস্তানের প্রধান জনগোষ্ঠী পশতুন। মোট জনসংখ্যার ৪২ ভাগ। বেশির ভাগ তালেবান নেতাই এ জনগোষ্ঠীর। জনগোষ্ঠীর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে তাজিকরা। জনসংখ্যার ২৭ ভাগ। তালেবানের প্রধান প্রতিপক্ষ এখন তারাই। তালেবান প্রতিরোধে পশ্চিমা দেশগুলো এক অর্থে পরাজয় স্বীকার করেছে। ফলে পশ্চিমাদের সঙ্গে তালেবানের দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষটা হয়েছে অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে। প্রতিপক্ষের সঙ্গে যেন সন্ধি করেই আফগানিস্তান ছেড়েছে পশ্চিমা সামরিক বাহিনী। এ কারণেই কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিতে তালেবানের কোনও বেগ পেতেই হয়নি। কিন্তু কাবুল দখল হলেও পুরো আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এখন তালেবানকে লড়তে হবে তাজিকদের বিরুদ্ধে।