রবিবার, এপ্রিল ১৪, ২০২৪

তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান ও বিশ্ব রাজনীতি

যা যা মিস করেছেন

আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা দখলের ফলে আন্তর্জাতিকভাবে যে তাৎক্ষণিক চাপ তৈরির আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা হয়নি। কৌশলী তালেবানদের নিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের আপাতত ‘অপেক্ষার নীতি’ ও ‘নরম সুর’ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারকে সহসা বিপদে না ফেললেও সামনের দিনগুলোকে সহজ করে তুলেবে বলে মনে হয় না। কারণ, ইতিমধ্যেই পশ্চিমা দেশগুলো তালেবানদের ক্ষমতা দখল নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে এবং কাবুলে চার/পাঁচটি বিদেশী দূতাবাস ছাড়া অধিকাংশই বন্ধ রয়েছে বা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে দেশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর তালেবানদের বিশ্ব রাজনীতির গতি নিজেদের পক্ষে আনতে মনোযোগী হতে হবে।

উল্লেখ্যযোগ্য বিষয় হলো, ক্ষমতায় আসার আগেই চীনের সঙ্গে রফা করে নিয়েছিল তালেবান নেতৃত্ব। ফলে কাবুল দখলের পর তালেবানদের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। পাকিস্তান আগে থেকেই এক পায়ে দাঁড়িয়ে ছিল তালেবানদের পক্ষে। আফগানিস্তানের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে রাশিয়া।

কাবুল দখলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তালেবানদের প্রতি ‘সন্তুষ্টি’ প্রকাশ করেছে রাশিয়াও।

আফগান পরিস্থিতিতে রাশিয়ার আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে বলা হয়েছে, ‘বিগত প্রশাসনের তুলনায় প্রথম চব্বিশ ঘণ্টায় কাবুলকে নিরাপদ করেছে তালেবানরা। অতীতের চেয়ে বর্তমান শাসন ভালো।’ এতটুকু বলেই নিবৃত্ত হননি রুশ প্রতিনিধি দিমিত্র জিরনভ। তাঁর ভাষায়, ‘আফগানিস্তানে রুশ দূতাবাসের নিরাপত্তার দায়িত্ব ইতিমধ্যেই তালেবান কর্তৃপক্ষ নিয়েছে।’ বরং কাবুলের রুশ দূতাবাসের টুইটার হ্যান্ডেল থেকে লেখা হয়েছে ‘রাশিয়া ও চীনের শক্তিবৃদ্ধির পটভূমিতে আমেরিকা ভীত।’

রাশিয়া ও চীনের মতো দুই প্রবল শাক্তিশালী প্রতিবেশী দুইপাশে দাঁড়ানোয় বিশ্ব রাজনীতির দুস্তর পথ অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে তালেবানদের জন্য। ইরানও তলে তলে মার্কিন বিরোধিতার কারণে তালেবানদের প্রতি সহানুভূতিশীল। আঞ্চলিক আরেক শক্তিধর রাষ্ট্র তুরস্ক শীর্ষ পর্যায় থেকে তালেবানদের সঙ্গে আপোস ও আলোচনার দরজা খুলে রেখেছে। রাশিয়া ও চীনের কারণে মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশ, কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান বাধ্য হবে তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভারত ছাড়া আঞ্চলিক ক্ষেত্রে আর কোনও রাষ্ট্রকেই তালেবানদের সামনে বৈরী অবস্থায় দেখা যাচ্ছে না।

বিশ্ব রাজনীতির চিত্রটাও মোটামুটি একই রকম। আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনী চলে যাওয়ায় পশ্চিমা কোনও দেশই আফগানিস্তানের বিষয়ে আগ বাড়িয়ে নাক গলিয়ে ফাঁদে পড়তে চাইবে না, যদিও তালেবানের বিষয়ে তাদের আপত্তির অন্তঃ নেই। তবে ক্ষমতা দখলের পর প্রথম সাংবাদিক সন্মেলনে ‘দেশে ও বিদেশে আমরা শত্রু চাই না’ মর্মে তালেবানদের স্পষ্ট উচ্চারণের পর কোনও দেশ নিজে থেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে দৌঁড়ে এসে শত্রু তালিকায় নাম লিখাবে বলেও মনে হয় না। এবং আমেরিকা ও ন্যাটো জোটের সামরিক অপসারণের পর নতুন কোনও সামরিক কৌশলের বদলে তারা অপেক্ষা করবে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তালেবানদের বাগে আনার জন্যে।

ফলে তালেবান বিরোধী কোনও মেরুকরণ গড়ে উঠতেও কিছুটা সময় লাগবে। কারণ, তালেবানের বিজয়ের মতোই আমেরিকার চরম পরাজয়ে সারা বিশ্ব বিস্মিত। ২০ বছরে ২ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে, অত্যাধুনিক অস্ত্র সজ্জিত ৩ লাখ যোদ্ধার বাহিনী বানিয়ে এবং আনুসাঙ্গিক যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেও মাত্র ৭৫ হাজার অপেশাদার তালেবান যোদ্ধাকে স্বল্প সময়ের জন্যেও ঠেকিয় রাখা যায় নি। এমন সামরিক পরাজয় অভাবণীয়। তাই অনেক ভেবে-চিন্তে এগুতে হবে তালেবান বিরোধী দেশগুলোকে। কারণ, সামরিক দিকের পাশাপাশি দীর্ঘ ২০ বছর সময় পেয়েও রাজনৈতিক দিক থেকে তালেবানদের মোকাবেলা করা সম্ভব হয় নি। সম্ভব হয় নি নির্বাচিত সরকার কিংবা সরকার ও জনগণের সম্পর্ক মজবুত করা। ফলে তালেবান সামরিক হামলায় তাসের ঘরের ধ্বসে পড়ে আমেরিকা কর্তৃক সমর্থিত আফগান সরকার, যাদের বিরুদ্ধে অদক্ষতার পাশাপাশি রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ।

রাজনৈতিক-সামরিক ব্যর্থতার মতোই কূটনৈতিক দিক থেকেও তালেবানদের তুলনায় আপাতত পিছিয়ে আছে প্রতিপক্ষ। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে তালেবানদের ক্ষমতাচ্যুত করার সময় তালেবানরা ছিল কোণঠাসা ও বন্ধুহীন। কিন্তু ২০ বছর প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে এবার যখন তালেবানরা আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয়, তখন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের গোপন ও প্রকাশ্য বন্ধুর সংখ্যা কম নয়। তদুপরি ‘সেই’ তালেবানের চেয়ে ‘এই’ তালেবান কর্মক্ষেত্রে ও বক্তব্যের দিক থেকে অনেক ‘সাবালক’ ও ‘কৌশলী’।

এমন সব বিষয় বিশ্ব রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে সক্ষম ও তালেবানদের জন্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জায়গা করে নেওয়ার জন্য সহায়ক। ফলে দেশের ভেতরে বিরাট বিজয় লাভকারী তালেবানরা বিশ্ব রাজনীতিতে একতরফা মার খেয়ে হটে যাবে, এমন কোনও লক্ষণীয় কারণ আপাতত দেখতে পাচ্ছেন না বিশ্লেষকরা। তবে, এটা ঠিক যে, বিশ্ব রাজনীতির বিদ্যমান ভারসাম্য ও গতিশীলতায় অদূর ভবিষ্যতে তালেবানদের পক্ষে ও বিপক্ষে আন্তর্জাতিক মেরুকরণের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত সামনে চলে আসবেই। উতপ্ত আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক ও বিশ্ব রাজনীতিও যে অচিরেই গরম হয়ে উঠবে, তা প্রায়-নিশ্চিত।

অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।

প্রিয় পাঠক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্যামেইলবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন themailbdjobs@gmail.com ঠিকানায়।

More articles

সর্বশেষ

x  Powerful Protection for WordPress, from Shield Security
This Site Is Protected By
Shield Security