দেশে পেঁয়াজ সংকট মোকাবিলায় অন্যান্য মসলার মতো ‘পেঁয়াজ গুঁড়া’ উদ্ভাবন করেছে বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্র। উৎপাদন শুরু হলে দেশের মোট চাহিদার ৩০ শতাংশ পেঁয়াজের পচন রোধ করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা জানান, কাঁচার চেয়ে পেঁয়াজের গুঁড়া বেশি সাশ্রয়ী হবে এবং সংরক্ষণ করা যাবে।
বাজারে প্রচলিত অন্যান্য গুঁড়ার মতোই প্রক্রিয়াজাত করে রান্নার কাজে ব্যবহার করা যাবে এ গুঁড়া।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) নিয়ন্ত্রণাধীন বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার রায়নগরের মসলা গবেষণা কেন্দ্রে ২০০৪ সাল থেকে বিজ্ঞানী মো. মাসুদ আলম মসলা প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ে গবেষণা করছেন।
তিনি বলেন, ‘একবার আমেরিকা থেকে আমার এক আত্মীয় কয়েক প্যাকেট পেঁয়াজ ও রসুনের গুঁড়া পাঠিয়েছিলেন। সেটা দেখেই পেঁয়াজগুঁড়া নিয়ে গবেষণার ধারণা মাথায় আসে। কাজ শুরু করি, সফলও হই। এরপর রসুন, আদা, কাঁচা মরিচসহ পর্যায়ক্রমে অন্যান্য মসলা নিয়েও কাজ করি। তাতেও সাফল্য ধরা দেয়।
তখন অন্য বিজ্ঞানীদের দিয়েও দফায় দফায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও পদ্ধতিতে তৈরি গুঁড়া ও পেস্ট করা মসলার গুণগত মান, স্বাদ ও ঝাঁজ ঠিক আছে কি না, তা নিশ্চিত হয়েছি। পরে মসলার গুঁড়া, পেস্ট, আচার ইত্যাদি মোড়কজাত করে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার শুরু হয়েছে।
মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা বলছেন, পেঁয়াজ একটি পচনশীল পণ্য। দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের প্রায় ৩০ শতাংশ অপচয় হয়। আমদানি করা পেঁয়াজে অপচয়ের হার ৫ থেকে ৭ শতাংশ। মাঠ থেকে পেঁয়াজ তোলার পর তা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে গুঁড়া কিংবা স্লাইস করে সংরক্ষণ করা সম্ভব হলে অপচয় রোধ করা সম্ভব। কারণ, প্রক্রিয়াজাত পেঁয়াজ দুই–তিন বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। এতে পণ্যটির ঘাটতি ঠেকানো ও আমদানিনির্ভরতা কমানো সম্ভব। একইভাবে রসুন, কাঁচা মরিচ, আদাসহ অন্য মসলার অপচয়ও রোধ করা সম্ভব।
মসলাজাতীয় ফসলের গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্পের পরিচালক শৈলেন্দ্র নাথ মজুমদার বলেন, পেঁয়াজগুঁড়া ও স্লাইস আকারে বাজারজাত করা সম্ভব হলে পণ্যটির আমদানিনির্ভরতা অনেকখানি কমে আসবে। তিনি জানান, দেশে ৫৩ রকমের মসলা ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় ৩৫টি মসলা।
বিজ্ঞানী মাসুদ আলম বলেন, কৃষক ও উদ্যোক্তারা সহজেই পেঁয়াজ গুঁড়া করে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে পারবেন। খোসা ছাড়ানোর পর পেঁয়াজকে স্লাইস করে ফুটন্ত পানির বাষ্পে ভাপ দিতে হবে। আধা সেদ্ধ হওয়ার পর প্রিজারভেটিভ, সোডিয়াম মেটাবাই সালফাইড মেশানো পানিতে আধা সেদ্ধ পেঁয়াজ কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখতে হবে। এরপর স্লাইস রোদে বা তাপে শুকানোর পর তা গুঁড়া করে সংরক্ষণ কিংবা রান্নায় ব্যবহার করা যাবে। এক কেজি পেঁয়াজ শুকিয়ে সর্বোচ্চ ২০০ গ্রাম পেঁয়াজগুঁড়া মিলবে। এরপর তা পলিব্যাগে মোড়কজাত করে সংরক্ষণ ও বিপণন করা সম্ভব। পেঁয়াজের মতো প্রক্রিয়াজাত করে আদা ও রসুনও গুঁড়া করে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করা সম্ভব।
মাসুদ আলম বলেন, বাঙালি রমণীরা রান্নায় পেঁয়াজকুচি ও পেঁয়াজবাটা করে রান্নায় অভ্যস্ত। পেঁয়াজকুচি বা বাটা নানা ভোগান্তির কাজ। অথচ হাতের কাছে পেঁয়াজগুঁড়া থাকলে ঝটপট রান্না করা সম্ভব। কোনো বাসায় পাঁচ কেজি পেঁয়াজ লাগলে সেখানে এক কেজি পেঁয়াজগুঁড়াই যথেষ্ট।
এ গুঁড়ার মান সম্পর্কে এই গবেষক বলেন, পেঁয়াজ গুঁড়া করলে এর গুণগত মান ও স্বাদ আগের মতোই থাকবে। সম্পূর্ণ দেশীয় এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ছোট পরিসরেও উদ্যোক্তারা পেঁয়াজ গুঁড়া উৎপাদন করতে পারবেন, সংরক্ষণও করতে পারবেন সহজেই।
মসলা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য মতে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৩৫ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় প্রায় ২৪ লাখ টন। বাকিটা আমদানি করতে হয়। পেঁয়াজের পাউডার বাজারজাত করা গেলে আমদানি কমবে। উদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে দেশে পেঁয়াজের পাউডারের বাজার তৈরি করলে বিপুল আয়ের নতুন পথ খুলবে।