আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ বিডিআর (তত্কালীন) বিদ্রোহের সাত বছর পূর্ণ হলো। ২০০৯ সালের এই দিনে তখনকার বাংলাদেশ রাইফেলস- বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি- বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) বিপথগামী সদস্যরা বিদ্রোহ করে। এ সময় তারা ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বিজিবি’র সদর দফতর পিলখানায় সেদিন বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, তা পৃথিবীর কোনো বাহিনীর বিদ্রোহের ইতিহাসে পাওয়া যায় না। বিদ্রোহীদের হাতে বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদও নিহত হন। বিদ্রোহীদের হাত থেকে রেহাই পায়নি মহাপরিচালকের স্ত্রী, বাসার কাজের মেয়ে ও বেড়াতে আসা আত্মীয়রাও।
এই সাত বছরে বাহিনীর নিজস্ব আদালতে বিদ্রোহের বিচার শেষ হয়েছে। এ ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার বিচার নিম্ন আদালতে শেষ হয়েছে। এখন উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে। বিস্ফোরক আইনে দায়ের হওয়া মামলার বিচার চলছে নিম্ন আদালতে। তারপরও এ বিদ্রোহের নেপথ্য কারণ নিয়ে নানা প্রশ্ন ও সংশয় রয়েছে। মামলার রায়ে বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে জওয়ানদের ক্ষোভের কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে নিহতদের পরিবারগুলোর দাবি, নেপথ্য কারণ শুধু ক্ষোভ নয়, আরও কিছু থাকতে পারে। তারা মনে করছে, মূল পরিকল্পনাকারী এখনো চিহ্নিত হয়নি।
অবশ্য বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেছেন, ‘আমি নিজে বিদ্রোহের বিচার-প্রক্রিয়ার সঙ্গে ছিলাম। যাঁরা বিদ্রোহের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, তাঁদের সবাইকে চিহ্নিত করে বিচার করা হয়েছে। তবে এটা নিয়ে মানুষের মনে ভিন্ন ধারণা রয়েছে। বিজিবিতে আসার আগে আমিও এসব শুনেছি। আসলে এ বিদ্রোহের পেছনে যা ছিল, সব পরিষ্কার হয়েছে।’
বিডিআর বিদ্রোহের পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়েছিল। এ দুটি কমিটি এ ঘটনার তদন্ত এবং ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটতে পারে, সে ব্যাপারে বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল। কমিটি বিদ্রোহের নেপথ্যের কারণ চিহ্নিত করতে অধিকতর তদন্তের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু তা হয়নি। আর হত্যার ঘটনার তদন্তে পুলিশ বিদ্রোহের যে কারণ উল্লেখ করেছিল, তা নিয়ে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রশ্ন আছে।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তে সাবেক সরকারি কর্মকর্তা আনিস উজ জামানকে প্রধান করে সরকার একটি কমিটি গঠন করে। ২০০৯ সালের ৩ মার্চ থেকে এ কমিটি কাজ শুরু করে। চার দফা সময় বাড়ানোর পর ওই বছরের ২১ মে কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে জমা দেয়। কমিটি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ২৩ দফা সুপারিশ করেছে। স্বল্পমেয়াদি সুপারিশের মধ্যে ছিল, সেনা আইনে দ্রুত বিচার করা, বিডিআরের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করা, নিহত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করা, অশনাক্ত মৃতদেহ শনাক্ত করা, লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার করা এবং হতাহত সামরিক ও বেসামরিক লোকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশের মধ্যে ছিল, এ ধরনের জাতীয় সংকট মোকাবিলার জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে একটি ‘জাতীয় সংকট মোকাবিলা কমিটি’ গঠন করা। এ ছাড়া বিডিআর বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র যথাসময়ে উদ্ঘাটনে ব্যর্থতা এবং বিদ্রোহ দমনে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত প্রদানে ব্যর্থ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। জানা গেছে, এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জাতীয়ভিত্তিক একটি কমিটি হলেও বিদ্রোহে আগাম তথ্য সংগ্রহে ব্যর্থতার ব্যাপারে কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একইভাবে তিন বাহিনীর সমন্বয়ে একটি দ্রুত মোতায়েনযোগ্য একটি বাহিনী গঠনের কাজও হয়নি বলে জানা গেছে।
বিডিআর বিদ্রোহের পরে ওই ঘটনা তদন্তে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তৎকালীন কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল লে. জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি তদন্ত আদালত গঠন করেছিল সেনাবাহিনী। ২০০৯ সালের ১১ মে এ আদালত তাঁদের প্রতিবেদন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের কাছে হস্তান্তর করা করেন। ওই আদালতের প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল।
আদালতের সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সব বাহিনীতে বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করে আইন তৈরি করা। এর মধ্যে বিডিআরের জন্য নতুন একটি আইন হয়েছে। সেই আইনে বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে।
গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে নিহত কর্নেল কুদরত এলাহী রহমান শফিকের বাবা হাবিবুর রহমান বলেন, শহীদ পরিবারের সদস্যদের প্রশ্ন—‘কেন এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড হলো, কী তাঁদের অপরাধ? কারাই-বা এই নৃশংস কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী। মানুষ তা জানতে চায়।’
ওই অনুষ্ঠানে সুলতানা কামাল বলেন, ‘সেনাসদস্যদের যেভাবে হত্যা করা হলো সেটা আমরা সবাই মিলে একটি ঘটনায় পরিণত করলাম, কিন্তু তার শেষ দেখতে পাচ্ছি না। এই শোকের কোনো পরিসমাপ্তিও ঘটাতে পারছি না। এতে জাতিগতভাবে বিরাট বড় একটা দায় আমাদের সবার ওপর আছে বলে আমি মনে করি।’