মোঃ আব্দুল মান্নান মল্লিক, কলাম লেখক, দ্যা মেইল বিডি ডট কম।
আজ ভ্যালেনটাইন ডে-“ভালোবাসা দিবস”। আজকের দিনটা কি শুধু প্রেমিক-প্রেমিকাদের? না, তা কিন্তু নয়। তাহলে ভ্যালেনটাইন ডে বা ভালোবাসা দিবস কি এবং কাদের জন্য? “ভ্যালেনটাইন ডে” আসলে কিন্তু শুধু প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য নয়। “ভ্যালেনটাইন ডে” সবার জন্য উন্মূক্ত। আবাল-বৃদ্ধ, বনিতা থেকে শুরু করে সবার জন্যই এই ভ্যালেনটাইন ডে। বাবা-মা, ভাই-বোন, যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে সবার জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য এ দিনটি।
আমার বড় ছেলে আর ছোট ছেলে আমাদের খুব ভালোবাসে। আজ সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আমাকে ও তার মাকে খাম ধরিয়ে দিয়ে বল্ল যে, আব্বু-আম্মু তোমাদের জন্য একটা চিঠি, ধর। খামটা খুলে পড়ি যাতে ছোট কচি হাতে লিখা- ‘Happy Valentine day , dear Father & Mother’
“মানুষ মানুষের জন্য” এ কথাটি যেমন সত্য, তেমনি সত্য ভালোবাসাও। ভালোবাসা যে কত রকম হতে পারে তার বিভিন্ন উদাহরণ এই ত্রিভূবনে অনেক আছে। ভালোবাসা বলতে শুধু প্রেম নয় বা প্রেমকে বুঝায় না। প্রেম বলতে নারী-পুরুষের আবেগ জড়িত মোহকেই বুঝায় না।
ভালোবাসা বলতে বাবা-মা’র মধ্যে ভালোবাসা, বাবা-ছেলের মধ্যে ভালোবাসা, মা-মেয়ের মধ্যে ভালাবাসা, বন্ধু-বান্ধবীর মধ্যে ভালোবাসা তথা সকল ভালোবাসাকেই বুঝায়। ভালোবাসাকে একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে বাধা যায় না বা বাধাও উচিৎ নয়।
পৃথিবী জুড়ে “ভ্যালেনটাইন ডে” প্রচলিত হয় মধ্য আশির দশকে। তবে তা শুরু হয়েছে অনেক অনেক বছর আগে। “ভ্যালেনটাইন ডে”-এর ইতিহাস খুজতে গিয়ে অনেক ধরনের কাহিনীর কথা জানা যায়।
প্রধান যে কাহিনীটি প্রচলিত আছে তা হলো- রোমান একজন কৃশ্চিয়ান পাদরি বা সেন্ট-এর কাহিনী অনুসারে। সেই কৃশ্চিয়ান পাদরির নাম সেন্ট ভ্যালেনটাইন। তিনি ছিলেন পেশাই একজন পাদরি এবং একই সঙ্গে চিকিৎসক। কিন্তু সে সময় রোমানদের দেব-দেবী পুজার বিষয়টিই মুখ্য ছিল। তারা কৃশ্চিয়ান ধর্মে বিশ্বাসী ছিলনা। কৃশ্চিয়ান ধর্ম প্রচারের অভিযোগে ২৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস-এর আদেশে সেন্ট ভ্যালেনটাইনের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। সেন্ট ভ্যালেনটাইন যখন জেলে বন্দি ছিলেন তখন ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা তাকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে জেলের জানালা দিয়ে চিঠি ছুড়ে দিত। বন্দী অবস্থাতেই জেলার-এর অন্ধ মেয়ের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দেন সেন্ট ভ্যালেনটাইন চিকিৎসা করে। মেয়েটির সঙ্গে সেন্ট ভ্যালেনটাইন-এর যোগাযোগ ঘটে এবং পরবর্তীতে প্রেম হয়। মৃত্যুর আগে মেয়েটিকে লেখা এক চিঠিতে তিনি জানান -ফ্রম ইওর ভ্যালেনটাইন। অনেকের মতে, সেন্ট ভ্যালেনটাইনের নাম অনুসারেই পোপ প্রথম জুলিয়াস ৪৯৬ খিষ্টাব্দে ১৪ ফেব্রুয়রি সেন্ট ভ্যালেনটাইন ডে হিসেবে ঘোষণা করেন।
আরো একজন ভ্যালেনটাইনের নাম শোনা যায় ইতিহাসে। যুবকদের বিয়ে করতে রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস নিষেধ করেন যুদ্ধের জন্য ভালো সৈন্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ভ্যালেনটাইন নামে এক যুবক এই নিয়ম ভেঙে প্রথমে প্রেম করেন, তারপর আইন ভেঙে বিয়ে করেন। ফলে ভ্যালেনটাইনের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।
এরও বহু বছর আগে থেকে রোমানদের দু’টি প্রথার প্রচলন ছিল। প্রেম-বিয়ে এবং সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা বিষয়ে উৎসবের জন্য। লুপারকাসিয়া এসব উৎসবের অন্যতম। রোম শহরকে দেবতা লুপারকাস রক্ষা করতেন নেকড়ের আক্রমণ থেকে। অনুষ্ঠানের দিন তরুণরা প্রায় নগ্ন হয়েই দৌড়াদৌড়ি করত এবং নব বিবাহিতাকে তাদের চাবুক দিয়ে পেটাতো। তরুণীরা মনে করতো, এতে তাদের সন্তান উৎপাদন সহজ হবে। কেননা এটি ছিল সন্তান উৎপাদনের উৎসব হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারী এ উৎসব পালন করা হতো। এর অগের দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি তরুণ-তরুণীরা তাদের নাচের পার্টনার লটারীর মাধ্যমে নির্বাচিত করতো। ৪০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দুই দিনের এই উৎসবের সময় কমিয়ে একদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি পালন করা হয়। অনেকে মনে করতো ১৪ ফেব্রয়ারি পাখিরা পার্টনার বেছে নেয়। ফলে এ দিনটি ভালোবাসা/প্রেম নিবেদনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।
এদিনটি পালনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোমানরা বক্সের ভেতর নাম রেখে লটারি করে তাদের প্রিয়তম ও প্রিয়তমাকে বেছে নিতো। ১৭০০ সালে ইংরেজ রমণীরা কাগজে তাদের পরিচিত পুরুষদের নাম লিখে পানিতে ছুড়ে মারতো কাদা-মাটি মিশিয়ে। যার নাম প্রথমে ভেসে উঠতো সেই হতো তার প্রকৃত প্রেমিক।
ষোড়শ শতাব্দী থেকে সর্বপ্রথম কাগজের কার্ড বিনিময় শুরু হয়। ১৮০০ সাল থেকে তামার প্লেটে একই ডিজাইনের অনেক কার্ড ছাপা হত। এসব ঘটনাকে সামনে রেখেই বিশ্ব জুড়ে ভ্যালেনটাইন ডে পালিত হয়। এখন বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন জনের মধ্যে দেয়া-নেয়া করা হচ্ছে অসংখ্য কার্ড, ফুল, চকলেট ও নানান উপহার সামগ্রী। ভ্যালেনটাইন ডের ব্যাপ্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে বিশ্বব্যাপী।
বাংলাদেশে এদিনটির অবস্থান একটু ভিন্ন। এখানে ভ্যালেনটাইন ডে পালিত হয় “ভালোবাসা দিবস” হিসেবে। এখানে আরো যে বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, বিশ্ব জুড়ে মূলতঃ প্রেমিক-প্রেমিকারা অথবা স্বামী-স্ত্রীরা ভ্যালেনটাইন ডে পালন করে থাকলেও বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তা ছড়িয়ে পড়েছে বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-অনাত্মীয়, সন্তান, বন্ধু, প্রিয় ব্যাক্তিত্ব এমন কি পোষা প্রাণী থেকে শুরু করে গাছপালার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে। তাই এদিনে “ভালোবাসা দিবস” পালন বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। ভালোবাসা দিবসকে এদেশের মানুষ আন্তরিকভাবে একান্তই নিজের একটি দিন হিসেবে নিয়েছে। এ দিবস এখন পরিণত হয়েছে সাধারণ মানুষের প্রিয় দিবসে।